রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ‘আমরা একাত্তর’ এর জাতীয় সম্মেলন আগামী ৮ জুন প্রথম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।এ লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করেন সংগঠনটির চেয়ারপারসন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান। সংবাদ সম্মেলন পরিচালনায় সংগঠনের বক্তব্য তুলে ধরেন প্রধান সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা হিলাল ফয়েজী।
অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সংগঠনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক শরীফুল ইসলাম জুয়েল, আব্দুর রশিদ, মাহফুজা জেসমিন এবং রকিবুল আলম রুশো।
বক্তব্যের শুরুতে গণমাধ্যমকর্মীদের শুভেচ্ছা জানায় সংগঠনটি।
বক্তারা বলেন, ‘আমরা একাত্তর’ মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন। গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের সময় আমরা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ‘আমরা একাত্তর’ ব্যানারে একত্র হলেও এর কার্যক্রম তেমন অগ্রসর হয়নি। পরে করোনাকালে আমরা নতুনভাবে উদ্যমী হয়ে ‘দিন আনি দিন খাই’ এমন মানুষদের লকডাউন কালীন কঠিন সময়ে তাদের পাশে দাঁড়াই।
ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়ি বাঁধ এলাকায় এমন বিপন্ন শতাধিক পরিবারে তিনমাস ধরে দেশ-বিদেশের শুভানুধ্যায়ীদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করে ‘আমরা একাত্তর’ নতুনভাবে সক্রিয় হয়ে উঠি এবং একটি নির্বাহী পরিষদ গঠন করে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করি। নানারূপ কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিয়োজিত হয়ে আমরা দেশ জুড়ে সংগঠনের শাখা বিস্তার করে আগামী ৮ জুন প্রথম জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেছি।
তারা জানান, আমাদের প্রথম কর্মসূচিটি ছিল ‘বোন নবান্ন উৎসব’। এতকাল বোনেরা ভাইদের কল্যাণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। সেই কল্যাণ কামনাকে আমরা বোনদের স্নেহ এবং অভিনন্দন জানানোর বার্ষিক অনুষ্ঠানে পরিণত করে আসছি পরপর তিন বছর। এখানেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল মর্মবাণী অর্থাৎ ‘নারীর সম্মান’ ইস্যুটিকে বিবেচনায় নিয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৯৭১ সনের ২০ মে খুলনা জেলার চুকনগরের ‘গণহত্যা’ সম্পর্কে আমরা ১৯৭১ এর অন্যান্য স্থানের ‘গণহত্যা’র মতোই গণ্য করে আসছিলাম। ‘আমরা একাত্তর’ সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা আমরাও নিজেদের এক্ষেত্রে অপরাধী গণ্য করছি। তীব্র প্রতিকূল অবস্থায়ও আমরা একাত্তরের নৃশংসতা, অত্যাচার এবং নানারূপ ইতিবৃত্ত তুলে ধরার অনেক কার্যক্রমে নিয়োজিত হয়েও ‘চুকনগর জেনোসাইড’ যে মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যালীলাযজ্ঞ তা উপলব্ধি করতে পারিনি।
স্বল্পতম সময়ে মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেদিন ন্যূনতম দশ হাজারের বেশি প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরে উন্মুখ দক্ষিণ বাংলার লাখো মানুষের ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল চুকনগর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই জেনোসাইড ঘটায়। সেদিন সমাহিত করার সুযোগ ছিল না।
চুকনগরের ভদ্রা নদীতে নিহত হাজার হাজার শিশু-যুবা-বৃদ্ধ-নারীদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আমরা দেশবাসী এই বীভৎসতার ব্যাপ্তি সবটাই সম্যক অবহিত ছিলাম না, এখনো নই। চুকনগর জেনোসাইডের ব্যাপ্তি এবং ভয়ংকর রূপটি স্বদেশে এবং বিশ্ব জুড়ে অবহিত করার এক উদ্যোগী কর্তব্য ২০২২ সালের ২০ মে শুরু করি। ভদ্রা নদীতে ভেসে যাওয়া হাজার হাজার নিহতের উদ্দেশ্যে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে সম্মান জ্ঞাপন করি বড় রকমের আয়োজনে।
জাতিসংঘের কাছে কারিগরী যথোপযুক্ত মানের জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে ‘আমরা একাত্তর’। আমরা সমধর্মী অন্যান্য সংগঠনের পাশে থেকে চুকনগরসহ সব জেনোসাইড প্রান্তরের স্মৃতি নবপ্রজন্মের কাছে তুলে ধরার অব্যাহত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছি। দেশের প্রতিটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করার ধারাবাহিক কর্মসূচি আমরা হাতে নিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী নবপ্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রধান আয়োজন আমাদের। এক্ষেত্রে ভার্চুয়ালসহ নানা কর্মসূচিতে অগ্রসর হচ্ছি।
আমাদের একটি বিশেষ কর্মসূচি হচ্ছে ‘গৌরব অর্জন উৎসব’। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্তরে নবীন-প্রবীণেরা সবিশেষ যেসব সাফল্য ও গৌরব বহন করে আনছেন আমরা বিশেষ অনুষ্ঠানে তাদের সম্মানিত করে আসছি। প্রতি বছরের শুরুতে বিগত বছরের কৃতিত্ব ও সাফল্য উদযাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতিসত্ত্বার ইতিবাচক অর্জনের বিষয়টি তুলে ধরছি।
২০২২-২৩ থেকে আমরা ১৯৭১ সনের বাংলাদেশে সংগঠিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে দেশ-বিদেশে প্রচারাভিযান জোরদার করে তুলছি। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে একাত্তরের বাংলাদেশ জেনোসাইড ইস্যুকে অর্ন্তভুক্ত করার প্রয়াসে প্রবাসী দেশবাসীদের মহতী উদ্যোগে সংযুক্ত হই।
নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর বাংলাদেশি প্রবাসীদের সম্মেলনে ১৯৭১ সনে বাংলাদেশে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম জেনোসাইড এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে ‘আমরা একাত্তর’ আয়োজন করে এক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। স্বদেশে বিদেশে ত্রিশের অধিক স্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ইস্যুটিকে তুলে ধরি।
একই ধারায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আয়োজন করি জাতিসংঘ স্বীকৃতির দাবিতে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যেখানে ইউরোপের জনপ্রতিনিধি, জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজন এবং স্বদেশের সমধর্মী বিভিন্ন সংগ্রামী সংগঠন। ১৯৭১ সনের বাংলাদেশ জেনোসাইডের আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির জন্য দেশ-বিদেশে আমাদের সংগ্রাম চলবেই।
মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রকৃত অর্জনের কথাও তুলে ধরেন বক্তারা। তারা বলেন, বিগত ৫৩ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মূল মর্মবাণী কতটুকু বাস্তবায়িত হলো, নাকি আমরা তা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি এই হিসাব আমাদের করতেই হবে। আমরা আমাদের সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্রে ব্যক্ত করেছি ‘শত বাধাবিঘ্ন-ঝড়ঝঞ্জা পেরিয়ে ৫৩ বছরে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্জন’।
নিঃসন্দেহে এটি আনন্দময় উদযাপনের যোগ্য। জাতির জন্মলগ্নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার শাসনতান্ত্রিক অঙ্গীকার থেকে বহুল বিচ্যুতি, প্রভূত উন্নয়নের সমান্তরাল সীমাহীন অর্থনৈতিক সামাজিক বৈষম্য ও নৈতিক বিপর্যয় আমাদের ব্যথিত করে, ক্ষুব্ধ করে। এমন পরিস্থিতি শুধু অন্ধতা তার অন্ধকারের শক্তিকে লালন করে, শক্তি যোগায়। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হই।
গৌরব উজ্জ্বল অতীতের পথ ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের আর্দশে একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, ন্যায় ও সমতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমাজে নতুন জাগরণ সৃষ্টির প্রয়াসে ‘আমরা একাত্তর’ অনানুষ্ঠানিক যাত্রা আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে আয়োজিত প্রথম জাতীয় সম্মেলন। ‘একাত্তরের প্রেরণায় জাগো, জাগাও’ এই মূল ধ্বনি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবই।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)