শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
দেশে দিনদিন চেনা দুর্যোগগুলো অচেনা হয়ে উঠছে, এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় বন্যা-ঘূর্ণিঝড়গুলো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। একইসঙ্গে অতি উচ্চ তাপমাত্রা ও প্রবল খরা দেশের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
সবমিলিয়ে চেনা দুর্যোগগুলো দিনদিন অচেনা হয়ে উঠছে। এই বছরে যদি দেশে আরও দুয়েকটা ঘূর্ণিঝড় হয়, তাহলে সেটা রিকভারি করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে।
সোমবার (১০ জুন) রাজধানীর লেকশোর হোটেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও সেভ দ্য চিলড্রেনের যৌথ আয়োজনে বাংলাদেশের উত্তর ও উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য স্থানীয় জনগণ ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শিশুদের জন্য পূর্বাভাস ভিত্তিক বহু আপদ মোকাবিলায় কার্যকর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ শীর্ষক কর্মশালা তিনি এসব কথা বলেন।
মিজানুর রহমান বলেন, অতিসম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালে আমরা দেখেছি ৪টি হাইটাইম নিয়েছে, যদিও অন্যান্য সময়ে সিঙ্গেল টাইমই হয়ে থাকে। অর্থাৎ রেমালে আমাদের উপকূলে ৪টি জোয়ার হয়েছে। এতে করে দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা পুষিয়ে উঠতে ওইসব এলাকার মানুষের যথেষ্ট সময় লাগবে। রেমালে ফিশারি সেক্টরেও বড় ক্ষতি হয়েছে, এবছর হয়ত আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দক্ষিণাঞ্চলে হয়ত এমন একটা সময় আসবে, যখন পয়সা দিয়েও জমি কিনতে পাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, কিছুদিন পূর্বে দেশে আমরা হিট ওয়েভ দেখেছি, তাপমাত্রায় পূর্বের সব রেকর্ড স্পর্শ করেছে। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি পরবর্তী হিট ওয়েভ আসার আগেই একটা প্রটোকল তৈরি করে ফেলতে পারব। আমাদের অবস্থান থেকে এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করছি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ডিজি বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালে ৫ জেলায় অন্তত ১৮ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। রেমালের এ তাণ্ডবে ভোলায় ৩, বরিশালে ৪, পটুয়াখালীতে ৪, পিরোজপুরে ৬ ও বরগুনা জেলায় ১ জনের মৃত্যু খবর পাওয়া গেছে। বড়দের মধ্যে ৫ নারী, ৫ পুরুষ এবং শিশুদের মধ্যে ৩ জন নারী এবং ৫ জন পুরুষ। আমরা চেষ্টা করেছি ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করতে। আমাদের সতর্কতায় যদি তারা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসতো, তাহলে হয়ত ক্ষতিটা হতো না। কোনো মূল্যবান প্রাণ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এটাই আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা।
তিনি আরও বলেন, এখনকার অনেক পরিবারেই শিশু নেই। তারপরও প্রতিবছর প্রায় ১৯-২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যাচ্ছে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। একটা সার্ভেতে আমরা দেখেছি, আরবান এলাকার ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাঁতার জানে না। গ্রামেও আগের মতো শিশুদের সাঁতার শেখানো হচ্ছে না। কিন্তু এই সমস্যার কারণেই দেশে সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় শিশুদের ছোটবেলায়ই সাঁতারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম, যেখানে মানুষ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং ভূমিধসের সম্মুখীন হয়। একইসঙ্গে দারিদ্র্য চক্রকে আরও খারাপ করে এবং দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে প্রভাবিত করে। উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু ঋতুগত বৈচিত্র্য, শৈত্য তরঙ্গ এবং টর্নেডোর মতো বিপদ নিয়ে আসে, ফলে মানুষের আয় ব্যাহত করে এবং সমাজের কিছু সম্প্রদায়কে বাস্তুচ্যুত করে। দুর্যোগের ঝুঁকিতে (ইনফর্ম ইনডেক্স) বিশ্বব্যাপী ২৭তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তথ্য বলছে, এই সময়ের মধ্যে দেশে ১ হাজার ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে পূর্বাভাসভিত্তিক পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের ৫টি জেলায় (বরগুনা, চট্টগ্রাম, খুলনা, পটুয়াখালী এবং সাতক্ষীরা) প্রয়োজনীয় জরুরি সহায়তা প্রদান করেছে। তারা ২৬ হাজার জনকে আগাম সতর্কবার্তা প্রদান, ৩ হাজার ৪৫০ জনকে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে প্রেরণ এবং ২ হাজার ৯০০ জনকে আশ্রয়ণ সহায়তা প্রদান করেছে।
এছাড়াও জার্মান ফেডারেল ফরেন অফিসের সহায়তায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট বহু-আপদ; বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধ্বসের ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনজীবনকে রক্ষা করতে শিশুকেন্দ্রিক কমিউনিটিভিত্তিক পূর্বাভাসভিত্তিক সাড়াদান কর্মসূচির মাধ্যমে কার্যকর প্রস্তুতি গ্রহণে উক্ত প্রকল্প বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা ও পটুয়াখালীর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাজ করবে। প্রকল্প এলাকায় দুর্যোগের ফলে শিশুদের জীবনের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি তাদের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়াও জলবায়ু এবং বহুআপদের ঝুঁকি নিরসনের জন্য আগাম সতর্কতা ব্যবস্থায় স্থানীয় জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রবেশগম্যতার সুযোগ বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় জনগণের ও প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস ভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি হবে যা শিশুদের ঝুঁকি ও ক্ষতি নিরসনে সহায়তা করবে।
কর্মশালায় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লুৎফুন নাহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আবদুল ওয়াদুদ, জার্মান দূতাবাসের প্রতিনিধি সিল্কি শিমার এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর ও প্রোগাম অপারেশনস রিফাত বিন সাত্তার।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)