শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
গ্রাহকের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে শরীয়তপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অফিসে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযান পরিচালনার সময় এক গ্রাহক অভিযোগ করলে দালাল ওই গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দেন।
সোমবার (১৫ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বিআরটিএ শরীয়তপুর অফিসে অভিযান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশনের মাদারীপুর টিম।
দুদক সূত্রে জানা যায়, সংস্থাটির হটলাইন নম্বর ১০৬ এ অভিযোগ ছিল রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা বদলি-যাচাই, পেশাদার-অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ ইত্যাদি সেবা নিতে বিআরটিএ অফিসকে গ্রাহকের অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়- এসব অভিযোগের ভিত্তিতে শরীয়তপুরের বিআরটিএ অফিসে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানের সময় গোসাইরহাটের তরসাতমাটিয়া গ্রামের কাওসার হাওলাদার নামে এক যুবক দুদক টিমের কাছে অভিযোগ করেন তিন বছর আগে বিআরটিএ অফিসের কর্মচারী পরিচয়ে ওবায়দুর নামে এক লোক তার কাছ থেকে সাত হাজার টাকা নিয়ে লাইসেন্স করে দেননি। পরে কাওসারের মোবাইল ফোন থেকে দালাল চক্রের সদস্য ওবায়দুলকে কল করা হলেও পার্শ্ববর্তী একটি চায়ের দোকানে যেতে বলেন ওবায়দুর। কাওসারের সাথে ছদ্মবেশে দুদকের টিম ওই চায়ের দোকানে গিয়ে ওবায়দুরকে হাতেনাতে ধরে বিআরটিএ অফিসের সহাকারী পরিচালক মো. নুরুল হোসেনের কক্ষে দালাল ওবায়দুল, ভুক্তভোগী কাওসার ও অফিসের মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানকে দুদকের টিম জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় ওবায়দুর কাওসারের কাছ থেকে ৭ হাজার টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন। পরে দুদক টিমের নির্দেশনায় ভুক্তভোগী কাওসারকে টাকা ফেরত দিলে ওবায়দুরকে ছেড়ে দেয় দুদক।
ভুক্তভোগী কাওসার হাওলাদার গোসাইরহাট উপজেলার তরসাতমাটিয়া গ্রামের ইয়াসিন হাওলারের ছেলে।
তিনি বলেন, তিন বছর আগে বিআরটিএ অফিসে এসেছিলাম লাইসেন্স করাতে। অফিসে আসার পরে ওবায়দুর নামে এক লোকের সাথে পরিচয় হয় আমার। তিনি তখন আমাকে বলেন, লাইসেন্স করতে তো ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাগে। আপনি ৯ হাজার টাকা দেন। উনার কথা মতো আমি এক চায়ের দোকানিকে সাক্ষী রেখে ৭ হাজার টাকা দেই তাকে। টাকা নিয়েও উনি আমার কাজ করেননি। তিন বছরে আমি প্রায় ৫ থেকে ৭টি মামলার শিকার হয়েছি। দুদক টিমের সহযোগিতায় আমার টাকা আমি ফেরত পেয়েছি আজ।
বিআরটিএ অফিসের দালাল চক্রের সদস্য ওবায়দুর রহমান বলেন, লোকবল সংকটের কারণে মৌখিকভাবে আমাদের অফিস সহায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আমরা কাজ করতাম। বিআরটিএ ঘুষ চক্রের সাথে সহকারী পরিচালক, ইন্সপেক্টর সবাই জড়িত। আমাদের শুধুমাত্র ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার হতে গিয়ে কিছু স্বার্থে এতদিন কাজ করেছি, এখন অফিসে লোক নিয়োগ হওয়ায় আমাদেরকে চলে যেতে বলেছে , আমরা এখন আর অফিসে আসি না। কিন্তু এখনো বিআরটিএ অফিসের ঘুষ বাণিজ্যের সাথে সহকারী পরিচালক, ইন্সপেক্টরসহ সবাই জড়িত। রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা বদলি-যাচাই, পেশাদার-অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স, রিনিউ লাইসেন্স সকল ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে ওবাইদুর বলেন, কোনো সেবাগ্রহীতা এলে সহকারী পরিচালক, ইন্সপেক্টর স্যার একটা চার্জ নেয়, ওই চার্জের ওপর ভিত্তি করে আমরা টাকা দাবি করি। তাদের বিভিন্ন ফাইলে বিভিন্ন ধরনের চার্জ। নির্দিষ্ট কোনো চার্জ নেই। অফিসারদের চার্জের ওপর ভিত্তি করেই অতিরিক্ত টাকা লেনদেন করা হয়। ফাইলে যত ভুল থাকুক, অতিরিক্ত টাকা দিলে সরকারের আইন অনুযায়ী কাজটা সম্পন্ন করে দেন তারা।
অতিরিক্ত টাকা কয় ভাগে ভাগ করা হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুর বলেন, আমাদের মতো অনেক লোকই আছে। এই জেলায় অনেক শোরুমের লোকজন আছে, বিভিন্ন যানবাহনের মালিক সমিতির লোক আছে। এদের সাথে অফিসাররা যোগাযোগ রক্ষা করে। টাকার ভাগ তো অনেক ভাগে বিভক্ত হয়। বলতে গেলে তো বড় বড় রাঘব-বোয়ালদের নাম চলে আসবে। বিআরটিএ সেক্টরের সভাপতি এডিএম স্যার, জেলা টিআই স্যার সদস্য, সিভিল সার্জন স্যার সদস্য। নিশ্চিত করে বলতে পারব না যে এরা ভাগ পায়, কারণ আমি তো সরাসরি দেখিনি। কিন্তু এখানে যেসব কর্মকর্তা আছে তারা সবাই ভাগ করে খায়।
বিআরটিএ শরীয়তপুরের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত) মো. নুরুল হোসেন বলেন, দুদক টিম সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এসেছেন। তারা তাদের কাজকর্ম করে গেছেন। আমি বিআরটিএ শরীয়তপুরে যোগদানের পর এখানে কোনো দালাল নেই। যে অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক এসেছে, সেই অভিযোগ আমি যোগদান করার অনেক আগের।
মোটরযান পরিদর্শক মেহেদী হাসানের সাথে দালালের সম্পর্ক রয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তার বিষয়ে যদি এমন কিছু পাওয়া যায়, তবে তা তদন্ত সাপেক্ষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি যোগদানের আগে কিছু গ্রাহককে হয়রানির দৃষ্টান্ত আছে। এখন আর কোনো গ্রাহক হয়রানির শিকার হয় না।
অভিযান শেষে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় মাদারীপুরের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, এক গ্রাহক বিআরটিএ শরীয়তপুর অফিস থেকে বিভিন্ন সময় হয়রানি ও ঘুষ লেনদেনের শিকার হন, এরই প্রেক্ষিতে আমাদের হেড অফিস থেকে আমাদেরকে অভিযান পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দিলে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই করে দেখেছি। অভিযানে প্রাপ্ত রিপোর্ট আমরা হেড অফিসে পাঠাব। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, অভিযানের সময় একজন দালালকে আমরা ধরেছি। যে সেবাগ্রহীতা থেকে ওই দালাল টাকা নিয়েছিল, সেই সেবাগ্রহীতাকে আমরা টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)