শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে সর্বকালের সেরা দামে বিক্রি হচ্ছে আলু। আর বীজ আলুর মূল্য যেন লাগামহীন ঘোড়া। সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ কেজি ওজনের বস্তার আলুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০০-৬০০ টাকা। অথচ তিন থেকে চার বছর আগে ৫০০-৬০০ টাকায় পাওয়া যেতো পুরো ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা আলু। প্রতি কেজি বস্তার আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ২৭০০-২৯০০ টাকা। যা আলুর মূল্যের সর্বকালের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড। অথচ এক সপ্তাহ আগে যাহা ছিল ২২০০-২৩০০ টাকা।
এ মৌসুমে সাধারণ চাষিদের হিমাগারে তেমন আলু না থাকায় এতে লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।
বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধু সিন্ডিকেট। ফলে হিমাগার থেকে বের করার পর হাত বদলালেই বেড়ে যাচ্ছে আলুর দাম। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে উৎপাদক পর্যায়ে ২৮ টাকার আলু হাত বদলে ভোক্তার ব্যাগে উঠছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। ফলে ‘লাভের মধু’ খাচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। অথচ গত বছরের অক্টোবরের এ সময়ে খুচরা বাজারে আলুর দর ছিল ৪০ টাকা কেজি।
আলুর দাম বৃদ্ধির জন্য খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন পাইকারদের। আর পাইকাররা দুষছেন হিমাগার সিন্ডিকেটকে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, হাত বদলালেই বাড়ছে দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। ফোনে ফোনে দাম বাড়াচ্ছেন মজুতদাররা। এ অবস্থায় বাজার মনিটরিং জোরদার না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন ভোক্তারা।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মুন্সীগঞ্জে গত মৌসুমে ৩৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়। এতে ১০ লাখ টনেরও বেশি আলু উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর মধ্য নভেম্বর থেকে শুরু হবে চলতি বছরের আলু রোপণ মৌসুম। এ বছর ৩৪ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিমাগারে আলু সংরক্ষণের পরই শুরু হয় দাম বাড়ানোর খেলা। জেলার ৫৪ হিমাগারে মজুত আছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন আলু। এর মধ্যে ৫১ হাজার মেট্রিক টন রয়েছে খাবার আলু, সেই আলু নিয়েই চলছে অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজি। এরই অংশ হিসেবে অসাধু সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য উৎপাদনের শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলো থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে বের করছে আলু। কৃষকের কাছ থেকে ২৮ টাকা দরে কেনা ও হিমাগারে সংরক্ষণে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের খরচ পড়ে কেজি প্রতি ৩৮ টাকা। কিন্তু হিমাগারের গেটেই সেই আলু এখনো বিক্রি করছেন ৫৫-৬০ টাকা দরে। এরপর ৫ টাকা বৃদ্ধি করে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কেজি প্রতি ৬০-৬৫ টাকা দরে আলু বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। আর খুচরা বিক্রেতারা ৫ থেকে ৬ টাকা মূল্য বাড়িয়ে বাজারে ভোক্তাদের কাছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হিমাগার থেকে খুচরা বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত ৫ ধাপে হাত বদল হয়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অধিক মুনাফায় বিক্রি করায় আলুর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আলুর দরে বড় ফারাক, দেখলেই তা সহজেই বোঝা যায় বলে মন্তব্য করেন কৃষকসহ হিমাগার মালিকরা।
কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার সূত্রে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জে গত মৌসুমে বৃষ্টির কারণে দুই দফা আলু রোপণ করা হয়। এতে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়ে ১৭ থেকে ১৮ টাকা। কৃষক সেই আলু পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছে ২৮ টাকা কেজি দরে; যা ৫০ কেজির এক বস্তা আলুর মূল্য দাঁড়ায় ১৪০০ টাকা। কিন্তু এখন সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ টাকা বস্তা।
মিলন বেপারী নামের এক কৃষক বলেন, গত এক সপ্তাহ যাবৎ হিমাগারে রাখা আলু বিক্রি করার জন্য স্টোরে যাচ্ছি। প্রতিদিনই গিয়ে দেখি বস্তা প্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে বাড়ছে আলুর দাম। তাই বিক্রি না করে প্রতিবারই ফিরে আসছি। গত ৮-১০ দিন আগে যে আলু ছিল ২৪০০ টাকা বস্তা এখন তা ২৯০০ টাকা বস্তা। ৩০০০ টাকা বস্তা হলে বিক্রি করবো সেই আসায় আছি।
এদিকে টঙ্গিবাড়ীর বালিগাওঁ গ্রামের কৃষক বাবুল খান বলেন, প্রতি বছর প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করেছি। কিন্তু এ বছর বীজ পাচ্ছি না। গত বছরের হল্যন্ডের বাক্র হতে উৎপাদিত বীজ যা কৃষক স্টোরে রাখা ছিল, এ বছর ৫০ কেজি ওজনের ওই বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৪০০০ টাকা। আলুর জন্য ব্র্যাকের এজেন্টদের পেছনে ঘুরছি তারা আলু দেওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলছে না তাই আলুর বীজ নিয়ে শঙ্কায় আছি।
টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সিদ্ধেশ্বরী কোল্ড স্টোরের ম্যানেজার ফখরুল ইসলাম বলেন, আমাদের হিমাগারে ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ৬০ হাজার বস্তা আলু। আমরা এ বছর ২ লাখ ২০ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করেছিলাম। এখন আমাদের হিমাগারে ৭৩ হাজার বস্তা আলু আছে। এগুলোর মধ্যে অর্ধেক বীজ আলু।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, এ বছর অন্যান্য বারের তুলনায় প্রায় ৫০ হাজার টন আলু কম সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে জেলার ৬৪টি হিমাগারের ৫৪টিতে গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি খাবার ও বীজ আলু মজুত আছে। এখন মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে ৫১ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন খাবার আলু এবং ৬৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন বীজ আলু মজুত আছে। গত বছর এ সময়ে হিমাগারগুলোতে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন খাবার আলু এবং ৫৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন বীজ আলু মজুত ছিল। তারপরেও আলুর দাম বাজারে বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর উপযুক্ত কারণ মূলত আমার জানা নাই, কেন পর্যাপ্ত আলু হিমাগারে থাকা সত্ত্বেও আলুর দাম বাড়ছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সামির হোসেন সিয়ামের ভাষ্য, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে খুচরা বাজার থেকে শুরু করে হিমাগার পর্যন্ত তদারকি করা হচ্ছে। কেউ যাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আলুর দাম বাড়াতে না পারে সেদিকে নজরদারি করা হচ্ছে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)