সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২


কোভিড যোদ্ধাদের মানবেতর জীবন

বেতন নেই, নেই চাকরির নিশ্চয়তা– কীভাবে চলবে সংসার?

স্বাস্থ্য ডেস্ক

প্রকাশিত:২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৫৯

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

মহামারির সেই ভয়াল দিনগুলোতে যখন মানুষ ঘর থেকে বের হতেও ভয় পেত, তখন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে জীবন রক্ষা করছিলেন তারা। আজ সেই কোভিড প্রকল্পের (ইআরপিপি) স্বাস্থ্যকর্মীরাই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমেছেন। মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রকল্পের কর্মীরা এখন বেতনহীন। চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও নেই। তাই সংসারের চাকা সচল রাখা তাদের জন্য প্রতিদিন এক যুদ্ধ।

এ অবস্থায় চাকরি স্থায়ীকরণ, কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ এবং বকেয়া বেতনের দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপারডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা।

রোববার (২৭ এপ্রিল) রাজধানীর মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মূল গেটে সকাল ১০টায় অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন তারা, যা চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।

জানা গেছে, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে শেষ হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মৌখিক আশ্বাসে তারা জানুয়ারি থেকে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। বলা হয়েছিল প্রকল্প ছয় মাস বাড়ানো হবে এবং অর্গানোগ্রাম (ওপি) করে তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে আজও কোনো চুক্তি হয়নি, হয়নি বেতনের ব্যবস্থাও।

‘বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে কথা হয় সকাল থেকে অবস্থান কর্মসূচিতে আসা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আসিফ সজিবের সঙ্গে। ক্লান্ত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমাদের প্রকল্প ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়েছে কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আশ্বাসে আমরা ২৫ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ডিউটি করে আসছি। বলেছিল আমাদের চুক্তি ৬ মাস বৃদ্ধি করবে এবং ওপি করবে। ৬ মাস বৃদ্ধির বিষয়টি পিএসসি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য আটকে আছে। জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কি।’

তিনি বলেন, ‘সেই জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বেতন পাইনি। এই বয়সে এসে এভাবে চলা যায়? আমাদের অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে বাবার জন্য ওষুধ কিনতে পারি না। ছেলেমেয়ের মুখে ঠিকমতো খাবার তুলে দিতে পারি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি ব্যর্থ।’

পাশে বসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের আরটিপিসিআর ল্যাবের কনসালটেন্ট আব্দুর রহমানের কথায়ও ক্লান্তি আর অসহায়ত্বের ছাপ। বললেন, ‘মহামারির সময় একদিনও দায়িত্ব থেকে পিছপা হইনি। এখন কি সেই শ্রমের কোনো মূল্য নেই? দেশের সংকটকালে আমরা জীবন বাজি রেখে কাজ করেছি। আজ আমাদের জীবন এত অমূল্য হয়ে গেল?’

তিনি বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে আমাদের চাকরি স্থায়ীকরণ অত্যন্ত জরুরি। নতুন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন জনবল গড়ার চেয়ে আমাদের ধরে রাখাই হবে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত।’

পরিবার ভাঙছে, ভবিষ্যৎ অন্ধকার

ডেটা অপারেটর হিসেবে কাজ করা এক তরুণী বলেন, ‘শুধু ভাতের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। অথচ মানুষকে জীবন বাঁচানোর তথ্য সরবরাহ করেছিলাম আমি। নিজের খাবার খরচ চালাতে পারছি না, রুম ভাড়া বাকি। আমাদের কেউ কেউ এমন আছেন যারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। কারো সংসারে ধার-দেনার পাহাড়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মানুষ বাঁচাতে কাজ করেছি। এখন নিজের সন্তানকে ঠিকমতো খাবার দিতে পারি না।’

শুধু তিনি নন, উপস্থিত অনেক কর্মীর মুখেই শোনা গেল– সংসার টিকছে না, ব্যাংক লোন বকেয়া, বাসা ভাড়া দিতে না পারায় মালিক বাসা ছাড়তে বলছে এমন কথা।

আশ্বাসে আমাদের পেট চলবে না, লিখিত সিদ্ধান্ত চাই

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ইআরপিপি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো ও অর্গানোগ্রামের বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন। তবে আন্দোলনরত কর্মীরা বলছেন, ‘শুধু আশ্বাসে আমাদের পেট চলবে না। লিখিত সিদ্ধান্ত চাই, দ্রুত বকেয়া বেতন চাই।’

স্বাস্থ্যকর্মীরা মনে করছেন, কোভিডের সময় দেশে যখন মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল, তখন তাদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। এখন সেই ত্যাগের স্বীকৃতির বদলে তারা অবহেলার শিকার হচ্ছেন।

অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, ‘তখন তো বলেছিল তোমরা দেশের বীর। এখন আমরা কি? অভাগা?’

সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান

জানা গেছে, ইআরপিপি প্রকল্পে ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ল্যাব কনসালটেন্ট, ডেটা অপারেটর, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ কয়েক শতাধিক জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সবাই এখন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

তারা বলছেন, তাদের বাদ দিয়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হলে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হবে। এ অবস্থায় এসব কর্মী সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দাবি বাস্তবায়নে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তারা।

আউটসোর্সিং কর্মীরা জানান, তাদের মধ্যে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, নার্স, মেডিকেল টেকনিশিয়ানসহ স্বাস্থ্য খাতের নানা পদের দক্ষ জনবল রয়েছে। টিকা কর্মসূচি, র‍্যাপিড রেসপন্স টিম, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনা ও করোনা পরীক্ষা পরিচালনাসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে।

এর আগে গত বছরের ১৭ নভেম্বর সকাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এসময় তিন দফা দাবি জানান আউটসোর্সিং কর্মীরা। এগুলো হলো– কোভিড-১৯ মহামারি যোদ্ধাদের ৩১ ডিসেম্বরের পর চাকরি বহাল চাই; স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৯ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত পঞ্চম সেক্টর কর্মসূচিভুক্ত ওপিগুলো অতি দ্রুত ১ হাজার ৪ জন জনবলকে বহাল রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং কোভিড-১৯ যোদ্ধাদের বয়স শিথিল রেখে যথাযথ নিয়ম মেনে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত করতে হবে।

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:০৯ ভোর
যোহর ১১:৫৭ দুপুর
আছর ০৪:৩২ বিকেল
মাগরিব ০৬:২৯ সন্ধ্যা
এশা ০৭:৪৫ রাত

সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫