বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
ড্যাপ সংশোধন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা চূড়ান্ত করতে সরকারকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দিল আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। এই সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়িত না হলে আবাসন খাতের সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘোষণা দেন রিহ্যাব নেতারা। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট বলেন, মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের সমস্যা সমাধানে সরকারের সাথে বড় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে আবাসন শিল্পের সদস্যদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান রিহ্যাব। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করাই রিহ্যাব সদস্য প্রতিষ্ঠান সমূহের লক্ষ্য। আমাদের কার্যক্রমের উপর নির্ভর করে প্রায় দুই শতাধিক এর অধিক লিংকেজ শিল্প অর্থনীতির চাকা গতিশীল রেখেছে। ২ কোটি লোকের খাদ্যের সংস্থান হয়েছে এই আবাসন শিল্পকে ঘিরে। রিহ্যাব সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণেই আজ শহরগুলোতে সুন্দর সুন্দর নান্দনিক ভবন তৈরি হচ্ছে। জিডিপিতে প্রায় ১৫ শতাংশ অবদান রাখছে এই খাত। আমাদের কার্যক্রম এবং আমাদের দেখানো পথে ঢাকায় প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ পরিবার নিজ ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। আমরা আবাসন ব্যবসায়ীরা বাকি নাগরিকদের জন্যও এমন সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন আবাসনের ব্যবস্থা করতে চাই। আমাদের সেই সুযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, অশুভ কোন উদ্দেশ্যে আবাসন খাতকে কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে পতিত সরকারের কতিপয় দোসরদের প্রেসক্রিপশনে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কোভিড মহামারি চলাকালীন তড়িঘড়ি করে দেশের স্বার্থ বিরোধী বেআইনী ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) প্রকাশ করে। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মদদপুষ্ট একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করতে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ কে উপেক্ষা করে ও মাষ্টার প্ল্যান-২০১০ কে অন্যায়ভাবে রহিত করে কেড়ে নেন ২০০৮ এর ফার (ঋঅজ) অংশটুকু। সৃষ্টি করা হয় নগরবাসীর মধ্যে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য। এরপর থেকেই আমাদের প্রিয় রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে উন্নয়নে ধস নামে। স্থবির হয়ে যায় এই খাত সংশ্লিষ্ট অনেক শিল্প কারখানা। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।
ইতোপূর্বে সংবাদ সম্মেলনে আমরা বলেছিলাম- “এই খাতের স্থবিরতা না কাটলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে এবং অনেক নাগরিক বেকার হবে। বর্তমানে রড, সিমেন্ট সহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় উৎপাদন অর্ধেক এর বেশি কমিয়ে দিয়েছে। ড্যাপে ফার (ঋঅজ) হ্রাস করার পর ভবনের উচ্চতা কমে যাওয়াতে আমাদের হাতে নতুন প্রকল্প নেই বললেই চলে। ফলে আমাদের প্রকল্পগুলোতে নতুন নিয়োগ একেবারেই বন্ধ। উল্টো অনেকে বেকার হচ্ছেন কাজ না থাকায়। এই সব বেকার নাগরিক জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপকর্মে। ফলে আইন শৃংখলাতেই এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের স্বার্থেই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।
মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, এই ড্যাপের কারণে ঢাকা মহানগরের ৮০ শতাংশ অপরিকল্পিতই থেকে যাবে। শহর এমন একটা মরন ফাঁদে পরিনত হতে যাচ্ছে যাহাতে কোন রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়/দুর্ঘটনা ঘটলে অসংখ্য প্রাণহানী ঘটবে, কোনভাবেই উদ্ধারকর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌছাতে পারবে না। অথচ এই বৈষম্যমূলক ড্যাপের জন্য এখনও পতিত সরকারের লবিষ্ট (কয়েকজন প্লানার্স) মায়া কান্না করে বেড়াচ্ছে নিজস্ব স্বার্থ হাছিলের জন্য। ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা শহরের পরিবেশের উন্নয়ন ও রাস্তা-ঘাট প্রসস্থকরণের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারণ ফার (ঋঅজ) কমিয়ে দেওয়ার ফলে ভূমি মালিকগণ ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে মহল্লার রাস্তাগুলো অপ্রস্থই থেকে যাচ্ছে এবং ফাঁকা জায়গা/সেমিপাকা জায়গা/পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনগুলো অস্বাস্থ্যকরই থেকে যাচ্ছে। এক কথায় ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ এরিয়াকে অপরিকল্পিত রেখে নগরবাসীকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন ড্যাপের কারণে ভবনের আয়তন এবং উচ্চতা কমেছে। ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কৃষি জমি। রাজধানীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে ব্ল্যান্ড ফ্লো জোন, জলাশয় (ওয়াটার বডি) দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তারা নিশ্চুপ হয়ে আছেন। বৈষম্যমূলক ড্যাপের মাধ্যমে তারা শুধু ভবনের আয়তন ও উচ্চতা কমিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অন্য দিকে নজর নেই। এই ড্যাপে জলাশয় আইন এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, ২০ ফুট রাস্তা প্রসস্থ করণের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক এলাকায় আবাসিক ব্যবহার অর্থাৎ মিশ্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে শুদ্ধ আবাসিক এলাকা চাইলেও তৈরি করা সম্ভব না। নানা কারণে এই ড্যাপ বেআইনী। এই জন্য এই বেআইনী ড্যাপ অতি দ্রুত সংস্কার করার দাবী জানাচ্ছি। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করা অতি জরুরী।
রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫) টি তার পূর্বসূরী “কাঠামোগত পরিকল্পনা” অর্থাৎ “ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান” গেজেট করার পূর্বেই চূড়ান্ত করা হয়েছে যা পরিকল্পনা প্রণয়নের মৌলিক মানদন্ডের সাথে সাংঘর্ষিক। টাউন ইম্পুভমেন্ট এ্যাক্ট, ১৯৫৩ এর ৭৩ ধারার অধীনে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রথমে সরকারের বিবেচনাধীন কাঠামোগত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর যথাযথ ধারাবাহিকতায় বিদ্যমান আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষজ্ঞ ও জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে, রাজউকের আওতাধীন এলাকার জন্য ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা’ বা “ড্যাপ” চূড়ান্তকরণ করাই ছিল যৌক্তিকভাবে প্রত্যাশিত। ড্যাপে প্লাবনভূমিকে শ্রেণিবিভাগ করার সময় ২০০০ সালের ৩৬ নং আইনে প্রদত্ত প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। তৎপরিবর্তে “মুখ্য জলস্রোত”, “সাধারণ জলস্রোত” ও “সাধারণ প্লাবনভূমি” হিসেবে বন্যাপ্রবাহ এলাকাকে শ্রণিবিভক্ত করার কোন সুযোগ ২০০০ সালের ৩৬ নং আইনে নেই। এ সকল অঞ্চলে শর্তসাপেক্ষে ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন ও স্থাপনা অনুমোদনের প্রস্তাবনা, আইন, আদালতের আদেশ ও জনস্বার্থ পরিপন্থী।
তিনি বলেন, ২০০৮ এর ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কল্যাণে ঢাকা মহানগরের মহল্লার রাস্তাগুলো উল্লেখযোগ্য হারে প্রসস্থ হচ্ছিল, ভবনগুলোতে একাধিক বেইজমেন্ট করার কারণে বহুসংখক গাড়ী পার্কিংয়ের ব্যবস্থা হচ্ছিল, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ জায়গা উন্মুক্ত রাখার ফলে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, সবুজ ও পরিবেশ বান্ধব ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছিল। এছাড়াও টিনশেড/জরার্জীণ অস্বাস্থ্যকর পুরাতন ভবনগুলো ভেঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছিল। এই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এর মত ভালো বিধিমালা বাতিল করা হলে তা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। এতে ঢাকার জমির মালিকগণ ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।
সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দিয়ে রিহ্যাব নেতারা বলেন, উল্লেখিত সময়ের মধ্যে ড্যাপ সংশোধন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা চূড়ান্ত করা না হলে আবাসন খাতের সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কঠোর আন্দোলন করা হবে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)