সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২


ভারতের পানি বন্ধ করার হুমকিতে পাকিস্তানে আতঙ্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত:২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:৫৪

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

সিন্ধু নদ থেকে একটু দূরে নিজের শুকনো সবজির জমিতে কীটনাশক ছেটাচ্ছেন পাকিস্তানি কৃষক হোমলা ঠাকুর। তিনি তার ফসলের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। কারণ এ মুহূর্তে সূর্যের প্রখরতা বেশি, নদীতে পানি কম। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের পানি প্রবাহ বন্ধ করার হুমকি।

“যদি তারা পানি বন্ধ করে দেয়। এসব ফসলি জমি, পুরো দেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে।”— স্প্রে গানে পানি ভরতে নদীর দিকে যেতে যেতে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে এসব কথা বলেন ৪০ বছর বয়সী ঠাকুর। “আমরা অনাহারে মারা যাব।”-যোগ করেন তিনি।

হোমলা ঠাকুরের মতো একই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ১৫ জন কৃষক ও বিশেষজ্ঞ। কারণ গত কয়েক বছরে দেশটিতে বৃষ্টির পরিমাণ বহুলাংশে কমেছে।

বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে সিন্ধু নদের পানি চুক্তি হওয়ার পর গত বুধবার প্রথমবারের মতো এ চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত। সিন্ধু ও এগুলোর উপনদের পানিগুলো পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষকের পানির যোগান নিশ্চিত করে। ভারত বলেছে, “পাকিস্তান যতদিন পর্যন্ত আন্ত-সীমান্ত সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়া বন্ধ না করবে ততদিন এ চুক্তি স্থগিত থাকবে।”

গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মিরে হামলা চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানের নাগরিক বলে দাবি করেছে ভারত। কিন্তু পাকিস্তান এ হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দাবি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। সাথে হুমকি দিয়েছে, “পাকিস্তানের ন্যয্য পানির প্রবাহ বন্ধ বা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে।”

সিন্ধু নদ চুক্তির মাধ্যমে সিন্ধু ও এগুলোর উপনদীগুলোর পানি নিজেদের মধ্যে বন্টন করে আসছে পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ দুই দেশ।

সরকারি কর্মকর্তা এবং ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারত এ মুহূর্তে সিন্ধুর পানি প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না। কারণ চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানকে যে তিনটি নদীর পানি দেওয়া হয়েছে সেগুলোতে ভারত কোনো বড় স্টোরেজ বা বাঁধ তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু আগের সবকিছু কয়েক মাসের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।

ভারতের জলশক্তিমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল দুইদিন আগে এক্সে এক পোস্টে লেখেন, “সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না যায় সেটি নিশ্চিত করব আমরা।” তবে পানি বন্ধের হুমকিতে পাকিস্তানি কৃষকরা যে শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলেও তিনি জবাব দেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন, ভারত চাইলে কয়েক মাসের মধ্যে সিন্ধুর পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে দিয়ে তাদের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। একই সময়ের মধ্যে তারা হাইড্রোইলেকট্রিক বাঁধ তৈরির কাজও শুরু করতে পারবে। যা চার থেকে সাত বছরের মধ্যে শেষ হতে পারে।

এছাড়া ভারত তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে নদীর পানি প্রবাহ সম্পর্কিত তথ্য প্রদান বন্ধ করে দিতে পারে। তারা চাইলে বন্যা সম্পর্কিত তথ্য না জানানো এবং সিন্ধু সম্পর্কিত বার্ষিক বৈঠকেও যোগ না দিতে পারে বলে জানিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কুশভিন্দর বোহরা।

তিনি বলেন, “পানি কখন আসবে, কতটা আসবে সে ব্যাপারে পাকিস্তানের কাছে খুব বেশি তথ্য থাকবে না।” এই কর্মকর্তা সিন্ধু কমিশনের কমিশনারও ছিলেন। এখন সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। আর ভারতের এসব তথ্য ছাড়া পাকিস্তান তাদের কৃষি পরিকল্পনাও সাজাতে পারবে না বলে দাবি করেন তিনি। “এটি শুধুমাত্র কৃষি নয়। পানির স্বল্পতা পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদনেও প্রভাব ফেলতে পারে। যা তাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলবে।”— যোগ করেন কুশভিন্দর বোহরা।

যুক্তরাজ্যের পরামর্শক সংস্থা অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্টের দল প্রধান ও অর্থনীতিবিদ ভাকার আহমদে রয়টার্সকে বলেছেন, “ভারত পানি নিয়ে যে হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান সেটিকে অবমূল্যায়ন করেছে। ভারতের এ মুহূর্তে পানির প্রবাহ আটকানোর সক্ষমতা নেই, বিশেষ করে বন্যার সময়। তাই পানি খাতে পাকিস্তানের যেসব অপূর্ণতা রয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ করার এটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। পানি খাতে পাকিস্তানের অনেক অপূর্ণতা ও ফাঁকফোকর রয়েছে।”

চলমান দ্বন্দ্ব

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নরেন্দ্র মোদির সরকার সিন্ধু চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনার চেষ্টা করছিল। এছাড়া কৃষেণগঙ্গা নদীর আয়তন এবং সিন্ধুর অববাহিকায় নির্মাণাধীন রটল হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্টের ‘পানি জমা রাখার স্থান’ নিয়ে যেসব দ্বন্দ্ব রয়েছে সেগুলো হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা করছিল।

কিন্তু যেহেতু ভারত এখন সিন্ধু নদ চুক্তি থেকে সরে গেছে তাই তারা চাইলে এখন সিন্ধুতে নিজেদের ইচ্ছামতো অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে বলে দাবি করেছেন ভারতীয় কর্মকর্তা কুশভিন্দর বোহরা।

গত বৃহস্পতিবার ভারত পাকিস্তানে কাছে একটি চিঠি পাঠায়। এতে তারা জানায়, ১৯৬০ সালের চুক্তির পর সেখানকার জনসংখ্যা ও ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটেছে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব জ্বালানিও (হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্ট) আরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এরমাধ্যমে মূলত সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে নয়াদিল্লি।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় চুক্তিটি হলেও সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এতে তাদের শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু কাজ রয়েছে। এ চুক্তি নিয়ে বাকি দুই দেশ কি সিদ্ধান্ত নিলো এ নিয়ে তাদের খুব বেশি মতামত নেই।

নাদিম শাহ নামে এক পাকিস্তানি কৃষক, যিনি ১৫০ একর জায়গায় তুলা, আখ, ময়দা এবং শাকসবজি উৎপাদন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ভারতের পানি সরবরাহ বন্ধের কারণে তারা সুপেয় পানি নিয়ে শঙ্কিত। তিনি বলেছেন, “সবকিছু নিয়ে আমাদের আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আছে। কিন্তু ভারত যা করছে সেগুলো নিয়ে আমরা চিন্তিত।”

সিন্ধুর যে তিনটি উপনদীর পানি পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ সেগুলো দিয়ে ১৬ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমিতে সেচ দেন কৃষকরা। যা দেশটির মোট কৃষিজমির ৮০ শতাংশ।

করাচিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পাকিস্তান কৃষি গবেষণার কর্মকর্তা ঘাসারিব শওকত জানিয়েছেন, ভারত পানি নিয়ে যা করছে, এরকম পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান কখনো প্রস্তুতি নেয়নি। তিনি বলেন, “এ মুহূর্তে, আমাদের (পাকিস্তান) কোনো বিকল্প নেই। ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে যেসব নদী পরিচালিত হচ্ছিল সেগুলো শুধুমাত্র কৃষি পণ্য উৎপাদন নয়— শহর, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং হাজার হাজার জীবিকাকে সহায়তা করে।”

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তান-ভারত চারবার যুদ্ধে জড়ালেও এই সিন্ধু নদের চুক্তি নিয়ে একবারও আলোচনা হয়নি। কিন্তু ভারত এবার যা করেছে তারা বিপজ্জনক উদাহরণ হিসেবে থাকবে বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ বিলাওয়াল ভুট্টো।

তিনি বলেন, “আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে দ্বন্দ্বের মধ্যে জড়িয়ে আছি। সিন্দু পানি চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে, আমি মনে করি আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নতুন আরেকটি দ্বন্দ্বের দুয়ার খুলে দিব। যা অবশ্যই হওয়া উচিত নয়।”

সূত্র: রয়টার্স

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:০৯ ভোর
যোহর ১১:৫৭ দুপুর
আছর ০৪:৩২ বিকেল
মাগরিব ০৬:২৯ সন্ধ্যা
এশা ০৭:৪৫ রাত

সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫