শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


সুপারবাগ: ভারতের স্বাস্থ্য খাতে এক নীরব মহামারি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত:৪ জুন ২০২৫, ১২:৪৪

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

‘সুপারবাগ’ বলতে সেইসব ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবকে বোঝায়, যারা প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। এর ফলে এইসব জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণ চিকিৎসা করা অত্যন্ত কঠিন বা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে এবং বিশেষত ভারত মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে সুপারবাগের প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। খবর বিবিসি বাংলার।

বর্তমানে এটি এক জটিল পরিস্থিতি, বিশেষজ্ঞরা অন্তত তেমনটাই মনে করছেন। একদিকে, অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী না হয়ে ওঠা পর্যন্ত ব্যাপক পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা হচ্ছে যা মারাত্মক সুপারবাগের উত্থানে ইন্ধন জোগাচ্ছে। অন্যদিকে, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ না পেয়ে মৃত্যুও হচ্ছে অনেকের।

আসলে, মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনের ফলে ওই ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য অণুজীবের মধ্যে সেসব ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠছে, যা আসলে এগুলোকে ধ্বংস করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই অবস্থাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স।

এই পরিস্থিতিতে ‘সুপারবাগ’ নামে এক জাতীয় 'ব্যাকটেরিয়াল স্ট্রেন'-এর উদ্ভব হতে পারে, যা এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। এই অবস্থায় রোগীর সংক্রমণের চিকিৎসা করা কঠিন হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার যেমন দেখা গেছে, তেমনই নাগালের বাইরে থাকায় রোগীদের ওষুধ পেতে লড়াই করতে হয়েছে এমন ঘটনাও দেখা গেছে। এই দুই ধরনের পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে ‘গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ’ (জিএআরডিপি) নামক একটা সংস্থা অলাভজনক সংস্থার গবেষণায়।

তাদের গবেষণার বিষয় ছিল মূলত ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সহ আটটা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে কার্বাপিনেম-রেজিস্টেন্ট-গ্রাম-নেগেটিভ (সিআরজিএন) সংক্রমণের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকারিতা কতটা? এর জন্য প্রায় প্রায় ১৫ লক্ষ ঘটনা খতিয়ে দেখা হয়েছিল।

জিএআরডিপি-র তথ্য বলছে, ওই সমস্ত দেশে মাত্র ৬.৯% রোগী সংক্রমণের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, কার্বাপেনেম-রেজিস্টেন্স গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া এমন এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যা কার্বাপেনেম জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। এর আগে কার্বাপেনেমকে এই জাতীয় সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য শেষ অবলম্বন হিসেবে মনে করা হতো।

দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, কার্বাপেনেম-রেজিস্টেন্স গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ এবং তার চিকিৎসার প্রচেষ্টার বেশিরভাগ ঘটনাই ভারতে দেখা গেছে। এর চিকিৎসার জন্য ৮০% ক্ষেত্রে রোগী অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ কোর্স শেষ করলেও মাত্র ৭.৮% ক্ষেত্রেই উপশম সম্ভব হয়েছে। নবজাতক এবং বয়স্কদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে এই ধরনের সংক্রমণ। বিশেষত হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন এবং যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা তেমন শক্তিশালী নয়, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা গুরুতর হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনেক সময় হাসপাতালের আইসিইউতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই সংক্রমণ। এর চিকিৎসা করা কঠিন এমন কী কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিষয়ক পরামর্শক ডা. আব্দুল গফুর বলেন, এই সংক্রমণ সব বয়সের রোগীদের মধ্যে নিত্যদিনই দেখা যায়। আমরা প্রায়শই এমন রোগীও দেখি যাদের ক্ষেত্রে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করে না এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ যেন এক নিষ্ঠুর বিড়ম্বনা।

বিশ্বজুড়ে যখন অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার কমানোর চেষ্টা চলছে, তখন একইসঙ্গে দরিদ্র দেশগুলো নিঃশব্দে এক মর্মান্তিক সমস্যার সঙ্গে জুঝছে, কারণ সংক্রমণের চিকিৎসা সম্ভব হলেও তার জন্য প্রয়োজনীয় ওই সমস্ত জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক তাদের নাগালের বাইরে।

‘জিএআরডিপি’-এর গ্লোবাল অ্যাকসেস ডিরেক্টর এবং এই গবেষণার জ্যেষ্ঠ গবেষক ডা. জেনিফার কোহন বলেন, বহু বছর ধরে এই ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে মাত্রাতিরিক্তভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু কঠোর বাস্তব বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে হাই ড্রাগ রেজিস্টেন্স সংক্রমণে আক্রান্ত অনেক মানুষই প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের অ্যাক্সেস পাচ্ছেন না।

এখন প্রশ্ন হলো ভারতে ওষুধ-প্রতিরোধী সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক পেতে বাধা কোথায়?

চিকিৎসকদের মতে, এর নেপথ্যে একাধিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে- যেমন সঠিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানো, রোগ নির্ধারণের জন্য সঠিক পরীক্ষা করানো এবং যে ওষুধে কাজ হবে সেটা নাগালে পাওয়া। এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আরও একটা বিষয় হলো এর ব্যয়। এই অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অনেকগুলোরই দামই দরিদ্র রোগীদের নাগালের বাইরে।

এই প্রসঙ্গে চিকিৎসক আব্দুল গফুর বলেছেন, যাদের এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো কেনার সামর্থ্য রয়েছে তারা প্রায়শই এগুলো মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহার করে। আর যাদের কেনার সামর্থ্য নেই, তারা এই ওষুধ একেবারেই পায় না।

তার মতে রোগীদের নাগালে আনতে হলে, এই ওষুধগুলো আরও সাশ্রয়ী করতে হবে আর অপব্যবহার রোধ করতে হলে কড়া নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, নাগালের মধ্যে এই জাতীয় প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া এবং একইসঙ্গে অপব্যবহার রোধ করতে কার্যকর নীতি এবং শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা দুই-ই অপরিহার্য। কিন্তু নাগালের মধ্যে পাওয়া গেলেই যে এই সংকটের সমাধান হবে তেমনটা নয়। নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের ভাণ্ডার কমে আসছে। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নের হ্রাস এবং যে সমস্ত ওষুধ মজুত রয়েছে তা সীমিতভাবে পাওয়ার বিষয়টা বিশ্বব্যাপী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এমন এক অবস্থা যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক এবং পরজীবী সহ অণুজীবরা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ওষুধের উপস্থিতিতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে।

ডা. কোহেন বলেছেন, ভারত নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের অন্যতম বৃহত্তম বাজার। তারা নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের বিকাশ এবং অ্যাক্সেস- দুইয়ের জন্যই সফলভাবে কাজ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বেশ মজবুত এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স-এর বিষয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন ধরনের রেজিস্ট্যান্স-এর চিহ্নিতকরণ এবং তার সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি।

ডা. কোহন ব্যাখ্যা করেছেন, কোন রোগীর ক্ষেত্রে কোন অ্যান্টিবায়োটিক কাজে দেবে সেটা আরও ভালভাবে বুঝতে স্থানীয় ডেটা জোগাড় ও নথিভুক্ত করতে পারে ভারত। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ফাঁকফোঁকর যেমন চিহ্নিত করা যাবে, তেমনই অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার কার্যকারিতাও জোরদার করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, সঠিক ওষুধ যাতে নাগালের মধ্যে পাওয়া যায় তা-ও নিশ্চিত করা সম্ভব।

এমন উদ্ভাবনী মডেলের দেখা ইতোমধ্যে মিলেছে। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ ভারতের কেরালায় 'হাব-অ্যান্ড-স্পোক' মডেল ব্যবহার করে এই জাতীয় গুরুতর সংক্রমণের মোকাবিলা করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ‘হাব অ্যান্ড স্পোক মডেল’ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে একটা সাইকেলের চাকার স্পোকের মাধ্যমে। এই মডেলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটা কেন্দ্রীয় বিতরণী ব্যবস্থা বা 'হাব'। এই পয়েন্টের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ছোট ছোট আউটলেট একেবারে কেন্দ্রে থাকা বিতরণী ব্যবস্থা ওই সমস্ত ছোট ছোট আউটলেটকে নিয়ন্ত্রণ করে।

এখন গবেষকদের মতে, হাসপাতাল বা রাজ্যগুলোর মধ্যে ওই মডেলের মতো সমন্বিত বা প্রয়োজন মাফিক সংগ্রহ ব্যবস্থা থাকলে, নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যয়ও কমাতে পারে। ক্যান্সারের ওষুধ কর্মসূচির ক্ষেত্রে এই জাতীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে ইতিমধ্যে ফল মিলেছে।

সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক না পাওয়া গেলে সমস্যা বাড়বে। চিকিৎসকেরা নিরাপদে অস্ত্রোপচার করতে পারবেন না। ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বা দৈনন্দিন সংক্রমণ সারানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে।

ডা. গফুর বলেন, আমাদের হাতে যখন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এসে পৌঁছায় তখন তার সংরক্ষণ করা দরকার, এবং সেটা সঠিক রোগীদের কাছে পৌঁছানোও দরকার। ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার করাই এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়, পাশাপাশি এসব ওষুধ তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাও ততটাই চ্যালেঞ্জের, যাদের প্রকৃতপক্ষে এর প্রয়োজন রয়েছে।

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৩:৪৫ ভোর
যোহর ১১:৫৭ দুপুর
আছর ০৪:৩৭ বিকেল
মাগরিব ০৬:৪৭ সন্ধ্যা
এশা ০৮:০৯ রাত

শুক্রবার ৬ জুন ২০২৫