রবিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২ ভাদ্র ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
আফ্রিকার দেশ সেনেগালে বিশেষ স্কুল শুরু করেছে জাতিসংঘ। ‘স্কুল ফর হাসবেন্ড’ নামের এই স্কুলে আক্ষরিক অর্থেই শেখানো হয়, কীভাবে একজন পুরুষ ভালো স্বামী হতে পারেন। বিশেষ সেই স্কুল একদিন ঘুরে দেখেছে বার্তা সংস্থা এপি। সেদিন ইমাম ইব্রাহীম ডায়ান ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন, কেন পুরুষদের গৃহস্থালি কাজে আরও বেশি সাহায্য করা উচিত।
৫৩ বছর বয়সী ইব্রাহীম ডায়ান বলেন, ‘এমনকি নবীজি (সা.)ও বলেছেন, যে পুরুষ তার স্ত্রী-সন্তানকে কাজে সাহায্য করে না, সে ভালো মুসলিম নয়।’ তিনি আরও বলেন, আমি আমার শিশুদের গোসল করাই। এছাড়াও আমার স্ত্রীকে অন্যান্য কাজে সাহায্য করি আমি।’ ইব্রাহীম ডায়ান যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন সেখানে থাকা ১৪ জন হেসে উঠেন। অন্যরা হাততালি দেন।
পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশের মতো সেনেগালেও যেকোনো কিছুতে পুরুষের কথাই শেষ কথা। এমনকি পরিবার পরিকল্পনাসহ জীবন বদলে দেওয়ার মতো বড় বড় সিদ্ধান্তেও নারীদের কোনো মতামত নেওয়া হয় না। নারীর জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর জন্যও পুরুষ সদস্যের ‘অনুমতি’ নিতে হয়। এমন অবস্থা পরিবর্তন আনতে দেশটিতে ‘স্কুল ফর হাসবেন্ড’ নামের বিশেষ এই কর্মসূচি চালু করেছে জাতিসংঘ। এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য- সমাজের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে ‘ইতিবাচক পুরুষত্ব’ (পজিটিভ ম্যাসকুলিনিটি) জাগিয়ে তোলা।
ইমাম ইব্রাহীম জানান, জেন্ডার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কেও পুরুষদের সচেতন করার চেষ্টা করেন তিনি। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা থেকে শুরু করে এইচআইভির মতো রোগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। শুক্রবার জুমার নামাজের পরের খুতবায়ও এসব নিয়ে আলোচনা করেন ইব্রাহীম।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক নারী আমার খুতবার প্রশংসা করেন। তারা আমাকে জানান যে, তার খুতবা এবং স্কুল ফর হাসবেন্ডের ক্লাসগুলো করার পর তাদের স্বামীদের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।’ এমনকি পুরুষেরাও জানিয়েছেন, তারা এখন একজন স্বামী এবং বাবা হিসেবে নিজেদের আরও উন্নত করতে চান।
হাবিব ডিয়ালো নামের ৬০ বছর বয়সী এক পুরুষ জানান, ইমামের খুতবা আর জাতিসংঘের কর্মসূচির ক্লাস করার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন বাড়িতে সন্তান জন্মদান কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের বউ যখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল, তখন আমি তাদের হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে উৎসাহিত করি। যদিও প্রথমে আমার ছেলে একটু আপত্তি করছিল। হাসপাতালে খরচ কেমন হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সে। কিন্তু আমি যখন তাকে বুঝিয়ে বলি যে এটা তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য কতটা জরুরি, তখন যে বুঝতে পারে এবং রাজি হয়।’
২০১১ সাল থেকেই সেনেগালে এই কর্মসূচি চালিয়ে আসছে জাতিসংঘ। তবে, সম্প্রতি দেশটির নারী, পরিবার, লিঙ্গ ও শিশু সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে এটি। বর্তমানে দেশটির সরকার এই কর্মসূচিকে মাতৃত্বকালীন মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে বিবেচনা করছে। শুধু সেনেগাল নয়, নাইজার, টোগো, বুরকিনা ফাসোসহ আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশে চলছে জাতিসংঘের এই ‘হাসবেন্ড ফর স্কুল’ কর্মসূচি। জাতিসংঘ বলছে, এই দেশগুলোতে নারী স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়েছে।
পুরো সেনেগালে এই প্রকল্পের প্রায় ২০টি স্কুল রয়েছে। এসব স্কুলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ পুরুষকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এই ৩০০ পুরুষ এখন নিজের জনবসতিতে তার অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছেন।
খারি নডেয়ে নামের ৫২ বছর বয়সী এক নারী জানান, তার স্বামী আগে কোনো কাজেই হাত লাগাতেন না, কিন্তু এখন তিনি রান্নাও করেন।
২০২৩ সালে প্রতি ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ২৩৭ জন মা মারা গেছেন। একইভাবে, নবজাতকের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ভালো ছিল না—প্রতি ১ হাজার জন শিশুর মধ্যে ২১ জনই জন্মের প্রথম মাসেই মারা যায়। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ১ লাখ শিশুর বিপরীতে মাতৃমৃত্যু ৭০ জনের নিচে নিয়ে আনতে চায় তারা। একইসঙ্গে নবজাতকের মৃত্যুহারও প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে ১২-এর নিচে নামিয়ে আনতে চায়।
সেনেগালে জাতিসংঘের কর্মসূচির সমন্বয়ক এল হাদজ মালিক বলেন, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো, অধিকাংশ নারী বাড়িতে সন্তান জন্ম দেন। পুরুষদের শিক্ষার ফলে নারীদের গর্ভকালীন সময়ে তাদেরকে হাসপাতালে নেওয়া এবং তাদেরকে সহায়তা করেন। এছাড়াও পুরুষরা এই সময়ে গৃহস্থালি কাজ করেন। তবে তাদের মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)