বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় নির্বিচারে দেড় মাসের বেশি সময় হামলা চালানোর পর যুদ্ধবিরতি দিয়েছে ইসরায়েল। গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে এই চুক্তি করেছে তারা। হামলা বন্ধ হবে না বলে এতদিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বারবার যেটি বলে আসছিলেন, অবশেষে তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। এটিকে নেতানিয়াহুর জন্য চরম পরাজয় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে ২৫ বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। অপরদিকে ইসরায়েল ৩৯ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় টানা দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর চলতি সপ্তাহে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চার দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এটি শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) সকাল থেকে কার্যকর হয়েছে। এরই মধ্যে চুক্তির শর্ত মেনে ১৩ ইসরায়েলি নাগরিক ও ১২ থাই নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে হামাস।
হামাস-ইসরাইলের মধ্যকার এই যুদ্ধবিরতিকে ইসরায়েলিদের জন্য চরম পরাজয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আল জাজিরার কাছে তারা তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন।
প্রথমত, গত ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলার পর গোষ্ঠীটিকে নির্মূলে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েল। গাজায় উপত্যকায় নির্বিচার ও বিরামহীন বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। সপ্তাহ খানেক পর শুরু করে স্থল অভিযান। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলি বাহিনী যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছিল, দেড় মাসেও সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। হামাস ধ্বংস হয়নি বা গোষ্ঠীটিকে নির্মূল করতে পারেনি ইসরায়েল। তারা তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে এবং বীরের মতো লড়াই করেছে।
এই যুদ্ধে ইসরায়েলের অর্জন বলতে হাজার হাজার টন বোমা ফেলে গাজার কয়েক হাজার বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দেয়া। আর সাড়ে ১৪ হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিকে হত্যা।
ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তির পর আবেগাল্পুত ফিলিস্তিনি বন্দী। ছবি: রয়টার্স
দ্বিতীয়ত, হামাসের সামরিক অবকাঠামো বিশেষ করে সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে চেয়েছিল ইসরায়েল। কিন্তু ৭ সপ্তাহ ধরে সর্বাধুনিক সব অস্ত্র ব্যবহার করেও সুড়ঙ্গ ধ্বংস তো দূরে থাক, তার খোঁজই পায়নি তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাসের শত শত মাইল দীর্ঘ সুড়ঙ্গ এখনও আগের মতোই সক্রিয় রয়েছে।
তৃতীয়ত, ইসরায়েল বলেছিল, হামাসকে উৎখাত করে তাদের হাতে বন্দি ইসরায়েলি নাগরিকদের মুক্ত করে আনবে বা বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের ফলে হামাস জিম্মিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। কিন্তু তেমনটা একেবারেই ঘটেনি। হামাস জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকদের মুক্তি দেয়নি, বিনিময় করেছে।
এদিকে প্রাথমিকভাবে ১২ থাই নাগরিকসহ ২৪ জন জিম্মি মুক্তি পেলেও নেতানিয়াহুর বিপদ সহজেই কাটছে না। হামাসের সঙ্গে সংঘাতের কারণে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় চাপের মুখে পড়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।
আল জাজিরার সাংবাদিক রোরি চ্যালান্ড বলেন, গত ৭ অক্টোবর হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, বাধ্য হয়ে তার পুরো দায় কাঁধে নিতে হচ্ছে নেতানিয়াহুকে। কারণ দ্বিরাষ্ট্র সমাধান নস্যাৎ করতে ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে তিনিই হামাসকে শক্তিশালী করেছিলেন।
ফলে ইসরায়েলি নাগরিকদের কাছে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে ঠেকেছে। যা এতদিন যুদ্ধনীতির মাধ্যমে ধরে রেখেছিলেন তিনি। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভের নতুন এক জরিপ মতে, ইসরায়েলে যদি এই মুহূর্তে নির্বাচন হয়, নেতানিয়াহু নিশ্চিত হারবেন। তার দল লিকুদ পার্টির আসন সংখ্যা ৩২ থেকে ১৮-তে নেমে আসবে। গত বছরের (২০২২) নভেম্বরে ৩২টি আসন পেয়েছিল দলটি।
জরিপের তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে মাত্র ২৭ শতাংশ ইসরায়েলি নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন করে। নেতা হিসেবে বিরোধী দলীয় নেতা ও যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য গান্তজকে পছন্দ বেশিরভাগ ইসরায়েলির।
গাজাবাসীর স্বস্তি
দীর্ঘ ৪৮ দিনের ভয়ংকর আগ্রাসনের পর শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) গাজায় কার্যকর হয় ৪ দিনের যুদ্ধবিরতি। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ মানুষের মনে। তাই সাহস আর তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন নিরীহ মানুষগুলো। তবে হামলায় বাসস্থানগুলো টিকে আছে কিনা তা জানা নেই তাদের।
এদিকে জ্বালানির অভাবে গাজায় কোনো যানবাহন চলছে না। তাই কয়েক কিলোমিটার রাস্তা হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন এসব সাধারণ মানুষ। তবু মুখে লেগে আছে বিস্তৃত হাসি, চোখ জ্বলজ্বল করছে আনন্দে।
এক ফিলিস্তিনি বলেন, ভীষণ স্বস্তিবোধ করছি। বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। দীর্ঘ অত্যাচারের পর মনটা একটু বিশ্রাম পেয়েছে আমার। চারদিন পর যদিও আবার ফিরতে আসতে হবে। কিন্তু মন মানছে না। তাবুর অস্বস্তিকর নোংরা পরিবেশে আর ভালো লাগছে না। বাড়িতে গিয়ে এই চারদিন একটু স্বাভাবিক জীবনযাপন করবো।
ভুক্তভোগী এসব মানুষ বলছেন, সবাই যার যার বাড়ি ফিরছে। আমরা ফিরতে পারছি না। এটা ঠিক নয়। যুদ্ধ বিরতির শর্তে এটাও নিশ্চিত করা উচিত ছিল যে, সবাই যেন সবাই নিজের বাড়িতে ফিরতে পারে। এক ঘণ্টার জন্য হলেও নিজের বাড়িটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই।
বাড়ি ফেরা হোক বা না হোক, প্রাণ ভয় ছাড়াই অন্তত ৪ দিন শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেলো অসহায় গাজাবাসী। তবে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হবার সুযোগ নেই তাদের। কারণ বিরতি শেষ হলে আবার হামলার হুমকি দিয়ে রেখেছে ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের গত ৭ অক্টোবরের আকস্মিক হামলায় ১৪০০ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় ইসরায়েল। তবে সম্প্রতি সেই সংখ্যা কমিয়ে ১২০০ করা হয়েছে। এছাড়া হামাস ইসরায়েল থেকে ২৪০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে গেছে বলে জানায় নেতানিয়াহু প্রশাসন।
এরপর থেকে গাজায় ও পশ্চিম তীরে নির্বিচারে হামলা করছে ইসরায়েল। গাজার আবাসিক এলাকা, স্কুল, হাসপাতাল, জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার গুদাম, খাবারের দোকানসহ কোনো কিছুই হামলা থেকে বাদ যায়নি। এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ও গাজায় ইসরায়েলি হামলায় সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬০০টিরও বেশি শিশু। নিহত বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)