বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
উপসচিব পদে পদায়নের পরীক্ষা সম্পূর্ণ মেধাভিত্তিক করা, দেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাডেমিক এবং সার্ভিস হাসপাতালে ভাগ করা এবং বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে তিনটি বিভাগে বিভক্ত করাসহ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাছে অর্ধশতাধিকের বেশি প্রস্তাব করেছেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তবে এসব প্রস্তাবের মধ্যে মোটাদাগে প্রায় ২৫টি প্রস্তাবের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা ও সংস্কার কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের পরিবর্তে স্বতন্ত্র বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠন করে চিকিৎসকদের নিয়োগ, পদায়ন, উচ্চশিক্ষা, পদোন্নতি ও বদলি প্রস্তাবও করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের করা প্রস্তাবের প্রায় বেশিরভাগই আমলে নিয়েছে সংস্কার কমিশন। একইসঙ্গে গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের এসব প্রস্তাব সুপারিশে অন্তর্ভুক্তও করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করা। যেহেতু সব ক্যাডারে প্রবেশের বয়স সম্প্রতি ২ বছর বৃদ্ধি করে ৩২ বছর করা হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে প্রবেশের বয়সসীমা আগের মতো ২ বছর বৃদ্ধি করে ৩৪ বছর করা।
২. স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে যৌক্তিকভাবে বিভক্তিকরণ করা, যাতে স্বাস্থ্যশিক্ষার শিক্ষকদের বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি যথার্থতা নিশ্চিত করা যায়। দুই অধিদপ্তরের মধ্যে কার্যাবলী সঠিকভাবে বিন্যাস করে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৩. প্রস্তাবনায় রয়েছে উপ-সচিব পুল পদের পরীক্ষা সম্পূর্ণ মেধাভিত্তিক হতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপদগুলোতে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন।
৪. বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন (এবং জনস্বাস্থ্য) তিনটি ধারায় বিভক্ত করে পদবিন্যাস করলে বিদ্যমান অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। মেডিকেল কলেজের সংখ্যা যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা এবং শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে শিক্ষার্থীদের আসনসংখ্যা পুনর্বিন্যাস করা।
৫. দেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাডেমিক এবং সার্ভিস হাসপাতাল এই দুই ভাগে ভাগ করে একাডেমিক হাসপাতালের সার্বিক দায়িত্ব স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ এবং অধিদপ্তরের অধীনে ন্যস্ত করা।
৬. বিশেষায়িত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ঢাকার পাশাপাশি অন্য অঞ্চলকেও গুরুত্ব দেওয়া।
৭. নবনির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর আগেই জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করা।
৮. সাভারে নির্মিত ট্রেনিং সেন্টারটি দ্রুত চালু করা। মেডিকেল কলেজে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন। স্বাস্থ্য ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের চাকরিতে প্রথম যোগদানের ২ (দুই) বছরের মধ্যে ৪ মাসব্যাপী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ এবং প্রতিটি পদোন্নতির পর প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। উন্নতমানের প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের জন্য দেশে এবং বিদেশে ব্যবস্থা করা। ৪টি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করা। মেডিকেল ল্যাব রেগুলেটরি অথরিটি স্থাপন করা জরুরি প্রয়োজন।
৯. বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে তিনটি বিভাগে বিভক্ত করতে হবে। প্রার্থীর পছন্দ, তার একাডেমিক কার্যাবলী, পছন্দনীয় বিষয়ে সিট ও ট্রেনিং পোস্টের প্রাপ্যতা অনুযায়ী প্রেষণ নীতিমালা প্রণয়ন করা।
১০. স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামোগত ও শিক্ষা উপকরণ এবং বিশেষজ্ঞ মানবসম্পদের অপ্রতুলতা দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া। সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেবাপ্রদানকারীদের কারিগরি ও মোটিভেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে।
১১. সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বজনপ্রীতি মুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত পদোন্নতি হতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে জনবলের পদোন্নতি ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে মেধা, যোগ্যতা ও চাহিদার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা। অধিকতর কার্যকরী ব্যবস্থাপনার জন্য ইনস্টিটিউটগুলোর স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।
১২. শয্যা সংখ্যার উপর ভিত্তি করে বড় ইনস্টিটিউটগুলোর (৮০০ বা এর উপর) পরিচালক গ্রেড-১ প্রাপ্ত হবেন। শয্যা সংখ্যা ৮০০-এ নিচে ইনস্টিটিউটগুলোর পরিচালক গ্রেড-২ প্রাপ্ত হবেন।
১৩. এমবিবিএস পাস এবং ইন্টার্নশিপের পরে উপজেলা হাসপাতালে ৬ মাস ও জেলা হাসপাতালে ৬ মাস পোস্ট-ইন্টার্নশিপ ঐচ্ছিক ট্রেইনিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা। ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে ইমার্জেন্সি ও আউটডোর ব্যবস্থার গুরুত্ব দেওয়া।
১৪. ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৩ জন নার্স, ২ জন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও ৫ জন করে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ তৈরি করা। উপজেলায়, জেলায় ও বিভাগে আরও অনেক প্রশাসনিক পদ তৈরি করা। যেমন- জেলায় ডিসিএস (ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক), ডিসিএস (ওষধ প্রশাসন), ডিসিএস (প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ডিসিএস (প্রশাসন অ্যান্ড লিগ্যাল); উপজেলায়ও আরএমও ছাড়া ডিসিএসের সঙ্গে সমন্বয় করে ডেডিকেটেড এমও পদ তৈরি করা ও জব ডেসক্রিপশন তৈরি।
১৫. পদোন্নতি বোর্ড/কমিটিতে (এসএসবি/ডিপিসি) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একজন সিনিয়র অধ্যাপককে অন্তর্ভুক্তি করা। পদোন্নতি পদ্ধতি এইচআরআইএস ডাটাবেজে থাকা উইথ টাস্ক অ্যান্ড টাইমলাইন (কে কতদিন কোন পদে কোন দায়িত্ব পালন করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের নাম উক্ত পদগুলোর বিপরীতে চলে যাবে এবং সে অনুযায়ী তিনি, তারা সেটা সিলেক্ট করবেন ইত্যাদি)। নিয়মিত ডিপিসি এবং ফিট লিস্ট পাবলিশ করা এবং কেন কোন কর্মকর্তা ডিপিসি বা ফিটলিস্টে আসতে পারেননি তার ব্যাখ্যাযুক্ত মন্তব্য কলাম যুক্ত করা। তদসংগে উচ্চপদে পদোন্নতির শর্তগুলো সংস্কার করে ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি অন্য ক্যাডারের মতো নির্দিষ্ট সময় অন্তর এবং প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে করা ও আন্তঃক্যাডার সমন্বয় করা। বেসিক সাবজেক্ট এর শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ এবং ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টের চিকিৎসকদের চাকরির বয়সসীমা ৬২ বছরে বৃদ্ধি করা।
১৬. বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বরাদ্দ করা অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। আর্থিক ব্যবস্থার শৃঙ্খলা বজায় বাখার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। একাডেমিক কার্যক্রমে জড়িত শিক্ষকদের বিশেষভাবে বেসিক সাবজেক্টের শিক্ষকদের নন প্র্যাকটিসিং ভাতা মূল বেতনের শতভাগ বৃদ্ধি করা।
১৭. ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ সুবিধা হিসেবে শত ভাগ মূল বেতনসহ অতিরিক্ত প্রণোদনা/সার্ভিস চার্জ/ঝুঁকিভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। শিক্ষকদের পাঠদানের পাশাপাশি অতিরিক্ত সেবা প্রদান অথবা সরকারের ছুটির দিনে সময়ের অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
১৮. সরকারি হাসপাতালে সব রকম রোগ নির্ণয় পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা। মেডিকেল যন্ত্রপাতি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে প্রত্যেক ইনস্টিটিউটে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেইনটেন্যান্স ডিপার্টমেন্ট থাকা উচিত।
১৯. চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশাসনের কর্মরতদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান/ Teachers' Training Institute স্থাপন করা। প্রতি জেলায় চিকিৎসকদের জন্য উপযুক্ত আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ। কার্যকর হেলথ ইনস্যুরেন্স ও রেফারেল সিস্টেম চালু করা এবং বৈকালিক চিকিৎসা সেবা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের মাধ্যমে চালু করা।
২০. প্রস্তাবের মধ্যে আরও রয়েছে - স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে ও রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী (শয্যা সংখ্যা অনুযায়ী নহে) উন্নতমানের পথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা চিকিৎসকদের সময়ের দাবি। কর্মপরিবেশ উন্নয়ন জোরদার করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্ট্যাডার্ন্ড সেটআপ দ্রুত চালু করা। কর্মস্থলে চিকিৎসকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল হাজিরার পাশাপাশি সরেজমিনে তদারকি বাড়াতে হবে। বিধি বহির্ভূতভাবে অনুপস্থিত হলে বিধি অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)