মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
আগের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ৯টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। ওই ৯টি ধারাকে কুখ্যাত ধারা হিসেবে গণ্য করা হতো। এসব ধারাতেই বিগত সরকারের সময়ে ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ওই সব ধারায় দায়ের করা মামলাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এখন বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া কিছু কিছু আর্টিকেল পরিবর্তন করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, নতুন আইনে আগের যেসব বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত বিদ্বেষ বা বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচার-প্রচারণা বন্ধ সংক্রান্ত বিধান। স্পিচ অফেন্স বা কথা বলা, মতামত প্রকাশ করে যে অপরাধ তার মধ্যে মাত্র দুটি অপরাধ এই আইনে রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৬ মে) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এর অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এসব তথ্য জানান।
উপদেষ্টা বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই বলেছিলাম সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাদ হয়ে যাবে এবং যুগোপযোগী আইন করা হবে। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত যে স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ফায়েজসহ অনেককে কাজ করতে হয়েছে। ড্রাফট করেছি, আমরা সবাই মিলে অনেক পরামর্শ নিয়েছি। ২৫ বার ড্রাফট পরিবর্তন করেছি। সবচেয়ে বড় সমালোচক যারা তাদের সঙ্গে তিন ঘণ্টা একসঙ্গে বসে আমরা এটা ফাইনাল করেছি।
তিনি বলেন, আজকে এটা উপদেষ্টা পরিষদের মিটিংয়ে উত্থাপনের পর একটা সাজেশন আসছে। সেটা যুক্ত করা হবে। এই সপ্তাহের মধ্যেই প্রয়োগযোগ্য আইনে পরিণত হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, এই আইনে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো সাইবার স্পেসে নারী ও শিশু যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আগের যে আইনটা ছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সেখানকার ৯টি ধারা বাতিল করা হয়েছে। এই ৯টি ধারাই ছিল কুখ্যাত ধারা। এই ধারায় ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এখন বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া কিছু কিছু আর্টিকেলের পরিবর্তন করা হয়েছে।
মত প্রকাশের অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, স্পিচ অফেন্স বা কথা বলা, মতামত প্রকাশ করে যে অপরাধ তার মধ্যে মাত্র দুটি অপরাধ এই আইনে রাখা হয়েছে। একটি হচ্ছে নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনমূলক কনটেন্ট প্রকাশ এবং হুমকি দেওয়া। আরেকটি হচ্ছে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো।
তিনি বলেন, ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোর মধ্য দিয়ে সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া হয়। ধর্মীয় ঘৃণাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যাতে করে ভুল বোঝাবুঝি না হয় বা কেউ কাউকে হয়রানি করতে না পারে। ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য বা যেকোনো কনটেন্ট যা ধর্মীয় সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে সেটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে সংযুক্ত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের মাধ্যমে যদি কোনো সাইবার অপরাধ করা হয় সেটাকে শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। স্পিচ অফেন্স বা কথা বলা, মতামত প্রকাশ করে যে অপরাধ এবং নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনমূলক কনটেন্ট প্রকাশ ও হুমকি দেওয়া এবং ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোর মতো ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে সেটা আদালতে যাবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালত যদি দেখেন এই মামলার কোনো সারবত্তা নেই, তাহলে মামলার বিচারক প্রি-ট্রায়াল স্টেজেই সেটা বাতিল করে দিতে পারবেন। অর্থাৎ চার্জশিটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। অর্থাৎ ভুয়া মামলা হলে বিচারক সাথে সাথে সেটা বাতিল করে দিতে পারবেন। এছাড়া এ সংক্রান্ত অপরাধগুলোকে আমরা আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপসযোগ্য রেখেছি।
এ আইনে যেসব বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা আগের আইনে ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত বিদ্বেষ বা বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচার-প্রচারণা বন্ধ সংক্রান্ত যে বিধান সেটা বিলুপ্ত করা হয়েছে। কারণ এই বিধানে প্রচুর হয়রানিমূলক মামলা হতো। মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচারের জন্য যে বিধান ছিল সেটার জন্য বিশেষ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রচুর মামলা হতো। এই ধারা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে। ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন বা আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটতে পারে এ ধরনের কোনো কনটেন্ট বা কথাবার্তা প্রচারের ধারায় প্রচুর মামলা হতো। এ ধারাটিও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশের ধারাটিও বাতিল করা হয়েছে।
আসিফ নজরুল বলেন, যে ৯টি ধারা আমরা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করেছি, এসব ধারায় ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের করা হতো। মামলাগুলো এখন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই আইন যেদিন গেজেটে নথিভুক্ত হবে, তার আগের দিন পর্যন্ত বাতিল হওয়া ওই ৯টি ধারায় যতগুলো মামলা হবে তার সব স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া ইতোপূর্বে বিভিন্ন ধারায় যেসব মামলা হয়েছে, সেসব মামলাও বাতিল হয়ে যাবে। যেমন- সাইবার সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংগঠন অপরাধ ও দণ্ড, পরিচয় প্রতারণা ও ছদ্মবেশ ধারণের দণ্ড। এই ধারাগুলোও নতুন আইনে আছে। তবে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যাতে করে আগের আইনে দায়ের করা মামলাগুলো টিকবে না।
তিনি বলেন, নতুন আইনে আমরা জামিনযোগ্য ধারা করেছি। যেমন- সাইবার স্পেসে জালিয়াতির অপরাধ, ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিংসহ স্পিচ অফেন্স বা মতামত সংক্রান্ত যে অপরাধ হতো তা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল, তারা কনটেন্ট অপসারণ করবে যা আক্রমণাত্মক বা অপরাধমূলক। এজন্য যে অথরিটি সেট করা হয়েছে সেখানে সিভিল সোসাইটির সদস্য থাকবেন। এই বিধান সংযোজন করা হয়েছে। এই অথরিটি কোনো ধরনের কনটেন্ট অপসারণ করার পরে, যেমন ধরেন কোনো মানবাধিকার সংগঠনের কনটেন্ট অপসারণ করা হলো, তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। আদালত যদি তখন বলে এ ধরনের কনটেন্ট অপসারণ করা যাবে না, তখন ওই কনটেন্ট পুনরায় প্রকাশ করতে হবে। তবে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালত যদি বলে অপসারণ করা ঠিক আছে, তাহলে সেটা অপসারিত অবস্থায় থাকবে। অর্থাৎ নতুন আইনে আমরা অনেকগুলো রক্ষাকবচ সেট করেছি।
তিনি আরও বলেন, যেই কনটেন্টটা অপসারিত করা হবে তা জনগণকে জানাতে হবে। জনগণ সেন্সিটাইজড থাকবে আসলে সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কনটেন্ট অপসারণ করছে নাকি সত্যি সত্যি আইনগতভাবে অপসারণ করছে তা জানতে পারবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং যুব ও ক্রীড়া ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)