সোমবার, ৪ আগস্ট ২০২৫, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২
ছবি সংগৃহিত
দেশের ইতিহাসে স্মরণকালের অন্যতম বড় গণআন্দোলন হিসেবে বিবেচিত জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও এখনো হয়নি শহীদদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা। যাদের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার পতনের ইতিহাস রচিত হয়েছিল, সেই শহীদদের মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের গাফিলতি।
নানা ঘটা করে শহীদদের স্মরণ করা হলেও বাস্তবে তাদের তালিকা প্রণয়ন, পরিচয় শনাক্ত, কবর সংরক্ষণ বা আর্থিক সহায়তা—কোনো দিকেই দেখা যাচ্ছে না পর্যাপ্ত ও কার্যকর অগ্রগতি। সরকার এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যেও রয়েছে বিস্তর গরমিল।
শুরুতে শহীদদের নির্ভুল তালিকা তৈরির ঘোষণা আসলেও তা কার্যত থেমে গেছে। সরকার ঘোষিত তালিকায় এখন পর্যন্ত ৮৪৪ জনকে শহীদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট বলছে, নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০। যার মধ্যে ১১৮ জন শিশু। অন্যদিকে, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী শহীদ ৮২০ জন এবং আহত ১১ হাজার ৮৫০ জন। ফলে সংখ্যাগত এই পার্থক্য ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করছে।
অভ্যুত্থানের সময় রায়েরবাজার কবরস্থানে ১১৪ জন শহীদকে গণকবরে দাফন করা হলেও, আজও তাদের কারও পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ শনাক্ত করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে ৬টি বেওয়ারিশ লাশ। ২০২৫ সালের ১০ জানুয়ারি মর্গ কর্তৃপক্ষ এসব লাশের তথ্য প্রকাশ করে। পাঁচজন পুরুষ এবং একজন নারী শহীদের মৃতদেহের ময়নাতদন্তে উঠে আসে—পাঁচজনের মৃত্যু আঘাতজনিত, এবং একজনের মৃত্যুর কারণ ‘উচ্চ স্থান থেকে পতন’। এরপর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এসব লাশ শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
শহীদ মো. নাঈমের বাবা কামরুল ইসলাম জানান, তার ছেলের কবর পর্যন্ত এখনো ভালোভাবে বাঁধাই করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে সহায়তার প্রতিশ্রুতি এলেও, তা পেতে পরিবারগুলোকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। ‘সমাবেশে গেলে অনেক কথা বলা হয়, কিন্তু পরে আর খোঁজ রাখে না কেউ,’ বলেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, শহীদ পরিবারগুলোর অনেকেই এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেক শহীদের স্ত্রী সন্তানদের খাবার জোগাড় করতে গৃহকর্মীর কাজ করছেন। শহীদ পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, প্রতিশ্রুতি অনেক দেওয়া হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।
সরকার বলছে, যাদের শহীদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা, প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা, এবং ১ হাজার ৩৫৫ বর্গফুট ফ্ল্যাট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব সুবিধা কতজন পাচ্ছেন বা কীভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে, সে বিষয়ে নেই স্বচ্ছ কোনো তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহীদদের নিয়ে কাজ যেন কেবল ‘ফাইল ও ভাষণের মধ্যেই’ সীমাবদ্ধ। একবছরেও তাদের তালিকা চূড়ান্ত না হওয়া এবং লাশ শনাক্ত না করার ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রের সদিচ্ছা নিয়েই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবহেলা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দুঃখজনক পুনরাবৃত্তি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা নিয়েও আজ পর্যন্ত রয়েছে জটিলতা ও বিভ্রান্তি। তখনও শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সরকার নির্ভুল তালিকা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এবার জুলাই আন্দোলনের শহীদদের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সেই একই উদাসীনতা।
একইসঙ্গে রাজনীতির মাঠে এখনো চলছে ভোটকেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতির প্রদর্শনী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো শহীদদের রক্তের মূল্য না বুঝেই তা ব্যবহার করছে মিডিয়া কাভারেজ ও জনমত তৈরির জন্য। তারা বলেন, মিডিয়া গেলে শহীদরাও হারিয়ে যান।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে তৎকালীন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমেছিল। কোটা সংস্কার দিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন পরিণত হয় ফ্যাসিবাদবিরোধী গণজাগরণে। কিন্তু সে সময় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে, লাঠিচার্জ করে, গ্রেনেড ব্যবহার করে কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)