বৃহঃস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রশাসনিক নির্দেশনা এখনো বহাল রয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি)। এর ফলে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। আন্তর্জাতিক এসএমএস খাত থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে সরকার। গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের এক বছর পার হলেও রহস্যজনক কারণে জয়ের সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি বিটিআরসি।
সরকার পতনের কিছু দিন পর নীতিমালা অনুযায়ী খাতটি আন্তর্জাতিক গেটওয়ের (আইজিডব্লিউ) মাধ্যমে চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সংস্থাটি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা কার্যকর হয়নি।
জানা যায়, ২০০৮ সালে আইজিডব্লিউ চালুর পর থেকেই আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবা আইজিডব্লিউর আওতার বাইরে রেখে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (এমএনও) হাতে তুলে দেওয়া হয়। অথচ লাইসেন্সিং গাইডলাইনস ও আন্তর্জাতিক দূরপাল্লার টেলিযোগাযোগ সেবা নীতিমালা (আইএলডিটিএস) অনুসারে ইন্টারনেট ব্যতীত সব আন্তর্জাতিক সেবা আইজিডব্লিউর মাধ্যমে পরিচালনা করার কথা। অভিযোগ রয়েছে-মূলত বিদেশি মোবাইল কোম্পানিগুলোর চাপের কারণে বিটিআরসি তার নিজের প্রণীত গাইডলাইনস ও নীতিমালা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়।
পরে আইজিডব্লিউর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবা চালুর নিয়মতান্ত্রিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে। এতে বিটিআরসি আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবার ক্ষেত্রে অবিলম্বে আইএলডিটিএস নীতিমালা পরিপালনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর বিটিআরসির অধীনে এমএনও, আইসিএক্স ও আইজিডব্লিউ প্রতিনিধিদের নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়। তাতে সব পক্ষ টেকনিক্যাল বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়। একটি খসড়া ট্যারিফও নির্ধারণ করা হয়। আন্তর্জাতিক এসএমএস চালুর প্রস্তাবিত ট্যারিফ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে মন্ত্রণালয় প্রথমে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আইসিটি উপদেষ্টার অনুমোদন নিতে বলে।
বিটিআরসি ২০২০ সালের অক্টোবরে আইসিটি উপদেষ্টার অনুমোদন চাইলে তিনি প্রস্তাবটি নাকচ করেন। অচিরেই নতুন নীতিমালা আসবে-এই অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবা মোবাইল অপারেটরদের হাতে রেখে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। তার সেই মতামতই এখন পর্যন্ত প্রশাসনিক আদেশ হিসাবে চালিয়ে আসছে বিটিআরসি।
এ খাতে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তৎকালীন আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের আপত্তির কারণেই বিটিআরসি তখন লাইসেন্সিং গাইডলাইনস ও বিদ্যমান নীতিমালা বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। ফলে আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবা বিদেশি মোবাইল অপারেটরদের হাতেই থেকে যায়। যা শুধু আইএলডিটিএস নীতিমালার গুরুতর লঙ্ঘনই নয়, এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
বিভিন্ন বিদেশি অ্যাগ্রিগেটর ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে গড়ে ৩ কোটির বেশি আন্তর্জাতিক ইনকামিং এটুপি এসএমএস বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমান গড় বাজারদর এসএমএসপ্রতি ৮ সেন্ট (ইউএসডি) হিসাবে মাসে আয় ২৪ লাখ ডলার। বর্তমানে, মোবাইল অপারেটরদের থেকে বিটিআরসি সর্বোচ্চ মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার ডলার আয় করতে পারে (৫.৫% হারে রাজস্ব ভাগাভাগি এবং অতিরিক্ত ১% হারে সামাজিক দায়িত্ব তহবিল)।
কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী যদি আইজিডব্লিউর মাধ্যমে এই সেবা পরিচালিত হতো, সে ক্ষেত্রে বিটিআরসি শুধু আইজিডব্লিউ থেকেই ৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার (৪০% রাজস্ব ভাগাভাগি) আয় করতে পারত। উপরন্তু, আইসিএক্স এবং মোবাইল অপারেটরদের রাজস্ব ভাগাভাগি থেকে বিটিআরসি আরও ২ লাখ ৪৫ হাজার ডলার আয় করতে পারত। সব মিলিয়ে বিটিআরসির মাসিক আয় দাঁড়াত কমপক্ষে ১২ লাখ ৫ হাজার ডলার। অর্থাৎ বিটিআরসির বর্তমান আয় থেকে প্রায় ৮ গুণ বেশি। এ হিসাবে সরকার বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমানে প্রতিটি বিদেশি মোবাইল অপারেটর তাদের বিদেশে অবস্থিত সহ-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একতরফা চুক্তি করে আন্তর্জাতিক এটুপি (অ্যাপ্লিকেশন টু পারসন) এসএমএস পরিচালনা করছে। যা প্রকৃত ট্যারিফকে আড়াল করার সুযোগ তৈরি করেছে। এ খাতে বিদেশি মোবাইল অপারেটরদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক এসএমএস খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে রাখার পথ সুগম হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত ও মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পরিসংখ্যান মতে বৈধপথে কল আসার পরিমাণ ১০ কোটি থেকে কমে ১ কোটি ২০ লাখে নেমেছে। ফলে আইজিডব্লিউদের ব্যবসায়িক অস্তিত্ব বর্তমানে সংকটের মুখে। অনতিবিলম্বে আইএলডিটিএস নীতিমালা-২০১০ মেনে আইজিডব্লিউদের আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবা পরিচালনার অনুমতি দিলে এই কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের ব্যবসায়িক অস্তিত্ব টিকে থাকবে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় আট থেকে ১০ গুণ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে এই সেক্টরের শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
এ প্রসঙ্গে আইজিডব্লিউ অপারেটরদের সংগঠনের (আইওএফ) প্রেসিডেন্ট আসিফ সিরাজ রব্বানী বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী আইজিডব্লিউ অপারেটররা আন্তর্জাতিক ভয়েস কলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক এসএমএস ব্যবসায় প্রবেশাধিকার পাবেন ধরে নিয়েই ব্যাপক বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা এ ব্যবসা পরিচালনার অনুমোদন না পাওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।’
তিনি বলেন, যেসব খাতে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সক্ষমতা রয়েছে সেসব ব্যবসা বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। শুধু আইজিডব্লিউ খাতেই আমাদের পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা বিটিআরসিকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছি। অথচ নতুন নীতিমালা কিংবা বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে খুব একটা সমন্বয় করা হয় না। এটা খুবই অগ্রহণযোগ্য ও দুঃখজনক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইকবাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা পুরো সেক্টরেই রিফর্ম করার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক এসএমএস নিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটা নির্দেশনা ছিল। আমরা ওটা নিয়ে কাজ করছি। এ মাসের শুরুর দিকেও আমি স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে মিটিং করেছি। মোবাইল অপারেটর ও আইজিডব্লিউদের ডেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। প্রস্তাব পাওয়ার পর সবদিক দেখে যেটা ভালো হয় ও সরকারের রাজস্ব যাতে বাড়ে-সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক এসএমএস একটা পণ্য। এখন যে মডেলে চলছে তাতেও সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। তবে ২০০ কোটি টাকা রাজস্ববঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়।’
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)