শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
ব্যাংকে নিজের জমানো টাকা তুলতে পারছেন না গ্রাহক। কোনো কোনো ব্যাংক প্রতিদিন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা উত্তোলনের সীমা নির্ধারণ করে দিলেও সেটা নিজেরাই কার্যকর করতে পারছে না। আশা করছি, এই অবস্থা সাময়িক কিন্তু মন জানান দিচ্ছে নানান আশঙ্কার।
কতশত মানুষের সারাজীবনের সঞ্চয় সেখানে জমা ভাবুন! যেকোনো দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে সাময়িক একটা অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। তবে যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা ধারণ করি তাতে পরিবর্তনটাকে আমরা আতঙ্ক হিসেবে দেখি। এ কারণেই অর্থনৈতিক মন্দার আতঙ্কে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে মানুষের হুড়োহুড়ি লেগে গেছে।
একটা দেশের শিল্পকারখানা সেই দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে, পাশাপাশি এটি দেশের বড় কর্মসংস্থান খাত। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিল্পাঞ্চলে স্বস্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। দুইদিন পরপর এই খবর সেই খবরে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত প্রায়।
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থিতিশীল করা না গেলে অনেক ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অচিরেই স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ছোট-বড় কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া মানে কেবল যে একজন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হলেন বা তাকে ধরাশায়ী করা গেল ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। বরং সেখানে কর্মরত শত শত কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের জীবীকার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।
কোন প্রতিষ্ঠান দেশে ব্যবসা করবে আর কোন প্রতিষ্ঠান করবে না সেটা যদি কোনো দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে উঠানামা করে কিংবা সেই দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নির্ধারণ করে দেয় তখন তা পুরো জাতির জন্য অশনিসংকেত। আজ হোক কিংবা কাল হোক আমাদের প্রত্যেকেরই কারও না কারও তোপের মুখে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায় যেটা নাগরিক হিসেবে কোনোভাবেই প্রত্যাশিত না।
অদ্যাবধি আমরা জেনে গেছি, জন্ম ও মৃত্যুর মতো কিছু জিনিস আমাদের জীবনে অবধারিত, তার মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং তৎপরবর্তী অচলাবস্থা একটি। আমরা আরও জানি নির্দিষ্ট সময় পরপর দেশের সরকার পরিবর্তিত হবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে, ব্যবসাবাণিজ্য টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাবে, অর্থসূচক নিচে নামতে নামতে মাটিতে হামাগুড়ি খাবে।
এছাড়া আরও অনেককিছুই ঘটতে দেখা যাবে, যেটা হয়তো অকল্পনীয় ছিল সেটাও অবধারিতভাবে কপালে জুটে যাবে। কারণ সামগ্রিকভাবে ব্যবসাকে রাজনৈতিক সুবিধাভোগীর জায়গা থেকে অবমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। উৎপাদনশীল, রপ্তানিখাত, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার নির্ভর পণ্য খাত এবং এসএমই খাতসহ পুরো সেক্টরকে রাজনৈতিক ডামাডোল থেকে আলাদা করতে পারা কঠিন কোনো বিষয় না।
এইখানে কেবলমাত্র সরকারের সদিচ্ছা দরকার। যদিও যাদের কাছে আমাদের এমন প্রত্যাশা থাকে তারা নানাভাবে প্রমাণ করে ফেলে নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনা আসলে একটা মিথ। ক্ষমতায় থাকলে সেটা সম্ভব হয় না। সুতরাং অযথা এইসব দাবি-দাওয়া চেয়ে লজ্জা দেবেন না। বর্তমানে বাংলাদেশ তার তরুণকাল পার করছে। তরুণ দেশের নাগরিক হিসেবে এদেশের মানুষ এখন পর্যন্ত বাইনারি চিন্তার বাইরে কিছু ভাবতে পারে না, কিংবা বলা যায় কখনো পারবেও না।
হয়তো ওপরে ওপরে কিছুটা পলিশ হবে। যদিও চাইবো আমার অনুমান ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হোক। বাঙালি সবসময় বিরোধী দল হিসেবে সেরা পারফর্মেন্সধারী, আরেকটু ভালোভাবে বললে বলা যায় গঠনমূলক সমালোচনাকারী। বেশিরভাগ লোকের কাছে নিরপেক্ষতা ততক্ষণই নিরপেক্ষ, যতক্ষণ না সেটা তাদের নিজেদের বিপক্ষে যায়।
বাইনারি ভাবনায় আটকে থাকার কারণে দেশের জন্য যা কিছু মূল্যবান সেটাকে তারা অনায়াসে বাতিল করতে পারে। সেইসূত্রে তারা অস্বীকার করতে পারে, যে বাণিজ্য দেশকে অগ্রগতি এনে দেয় যদি সেই বাণিজ্য তার বিরুদ্ধ মতের কারও হাত ধরে প্রসার পায়। যতই সেটা দেশের জন্য অবদান বয়ে আনুক না কেন!
দেশের কাঠামোগত উন্নয়ন প্রতিদিনই হচ্ছে। যেগুলো চোখে দেখা যায়। কিন্তু কাঠামোর বাইরে যে দৈন্যদশা থাকে, খালি চোখে দেখা যায় না সেখানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারাটাই হতে পারে দেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন। আর যদি একবার সেটা পারা যায় তবে আন্তঃ কিংবা বহিঃ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন অর্থনীতির ওপরে কোনো বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে না। বরং অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটা খাতকে যুথবদ্ধভাবে রক্ষা করবে।
প্রায় বছর তিনেক ধরে টানা ডলার সংকট, স্টক মার্কেটের ক্রমাগত পতন এবং বর্তমানে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা সুতরাং বাইরের বিনিয়োগ নেই বললেই বলে। এরমধ্যে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভের মধ্যে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ আছে।
এর ফলে বিশ্ববাজারে আমাদের আস্থার জায়গা নষ্ট হয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষ দুইয়ে অবস্থান করার পরেও শুধুমাত্র বর্তমান রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে গার্মেন্টস কার্যাদেশ চলে যাচ্ছে অন্য দেশে।
একই অবস্থা বিরাজ করছে পাট ও চামড়া শিল্পেও। মূলত বিদেশি ক্রেতারা বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এড়াতে এবং পণ্যের সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই পন্থা অবলম্বন করছেন, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের জিডিপিতে। রপ্তানি বাণিজ্যের ওপরে দেশের জিডিপির একাংশ নির্ধারিত হয়।
জিডিপিতে সারা দেশের এসএমই ব্যবসায়ীদের অবদান ২৫ শতাংশ। সেই এসএমই ব্যবসায়ীরা দেশের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে কেমন আছেন, এই খোঁজ কি কেউ নিয়েছেন? কুটির শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের আসলে হতবিহ্বল অবস্থা। টানা প্রায় তিনমাস তাদের কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী মূলধন ভাঙিয়ে চলেছে।
পরিবর্তিত এই সময়ে ছোট স্কেলে হলেও ব্যবসাকে দাঁড় করানোর জন্য ব্যাংক হতে পারে তাদের একমাত্র ভরসা। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের ব্যবসায়ীদেরও প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বর্তমানের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অর্থায়ন সংকট বিশেষ করে ঋণ প্রাপ্তি। এর ওপরে যুক্ত হয়েছে ২০২৪ সালের অতিবৃষ্টি ও বন্যা।
অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদের কৃষি, ফল-ফসল ও প্রাণিসম্পদসহ ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসএমই খাত। এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়েছে। আবার সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের একটা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এসএমই খাত।
বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ব্যাংক অর্থায়নের সহজিকরণ ছাড়া এই খাতের বিকাশ যেমন কঠিন, তেমনি প্রণোদনা না পেলেও খাতটির বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না। এসএমই খাত প্রত্যক্ষভাবে এফকমার্স বিজনেসের সাথে যুক্ত। বর্তমানে এফকমার্স বিজনেস অনেকটাই কঠিন হয়ে গেছে।
পেইজ রিচ একেবারে নেই বললেই চলে এমনকি বুস্ট করলেও! এটা জোনাল কর্তৃপক্ষের প্রতি ফেসবুকের কোনো নির্দেশনা কিংবা ফেসবুকের কোনো পলিসি কিনা এসব জিজ্ঞাসাবাদের কোনো সুযোগ অন্তত এই খাতের ব্যবসায়ীদের নেই।
ওয়ার্ল্ডওয়াইড এফকমার্সের বিশাল মার্কেট। সুতরাং ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে ব্যবসায়ীদের তথ্য বিনিময়ের সুযোগ থাকার বলিষ্ঠ উদ্যোগ দরকার। তাতে করে এফকমার্স খাতের ব্যবসায়ীরা নতুন নির্দেশনা পাবে।
লেখকঃ প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)