শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্রম এবং উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কিন্তু শুদ্ধ শ্রমশক্তি বা যেনতেন উদ্যোগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিময় করতে পারে না, তার জন্য শ্রমশক্তি এবং উদ্যোগকে সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন হতে হবে।
অন্য কথায়, শ্রমশক্তিকে মানবসম্পদ হতে হবে। এটা অনস্বীকার্য যে, একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার ভৌগোলিক আয়তন নয়, তার প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার সুদক্ষ মানুষ এবং বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল জনবহুল দেশে এ কথাটি আরও সত্যি।
একটি দেশের মানবসম্পদ তিনটা পন্থায় তার অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে।
প্রথমত: উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানবসম্পদের সক্ষমতা ও অন্যান্য উপকরণকে সার্থক এবং কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারে। মানবসম্পদের অনুপস্থিতিতে ভূমি, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য উৎপাদন, উপকরণ কিছু জড় পদার্থ ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
দ্বিতীয়ত: উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির প্রভাব এবং অবদান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সেই প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্য যথার্থ মানবসম্পদ প্রয়োজন। আজকের বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের কালে সক্ষম এবং সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম।
তৃতীয়ত: মানব সভ্যতার উত্তরণে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, সৃষ্টিশীলতা এবং সৃজনশীলতার একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। একটি দেশের শ্রমশক্তি যখন এসব গুণাবলী অর্জন করে, তখন সেটা প্রাসঙ্গিক মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় শ্রমশক্তির উন্নত উৎপাদনশীলতার কারণে সেসব দেশের জাতীয় আয়ে শ্রমের অনুপাত অনেক বেশি। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আয়ে শ্রমশক্তির অংশ ৬২ শতাংশ। মেক্সিকোর মতো উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় আয়ে শ্রমের অংশ ৩৫ শতাংশ। এর কারণ, শ্রমের কম উৎপাদনশীলতা।
অন্যদিক থেকে দেখলে, উন্নত দেশে শ্রমশক্তি মানবসম্পদে পরিণত হয়েছে, কিন্তু অনুন্নত দেশে শ্রমশক্তির পরিপূর্ণ মানবসম্পদ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি আছে। উন্নত বিশ্বে বর্ধিত সক্ষমতার কারণে তাদের মানবসম্পদ প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে তাদের অগ্রগতিকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তি কাজের জগৎকেও বদলে দিয়েছে এবং নতুন নতুন মানবসম্পদের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকের বৈশ্বিক বাণিজ্যে জ্ঞান-সম্পৃক্ত পণ্য বাণিজ্যের অংশ ক্রমবর্ধমান। পুঁজিঘন বা শ্রমঘন পণ্যের বাণিজ্যের তুলনায় জ্ঞান-সম্পৃক্ত বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিহার অনেক বেশি—এ প্রবৃদ্ধিহার পণ্যসামগ্রীর বাণিজ্যের চেয়ে ১.৩ গুণ বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে জ্ঞান-সম্পৃক্ত পণ্য বাণিজ্য বিশ্বের মোট পণ্য বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ। সুতরাং যাদের আজকের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার মতো সম্পদ ও দক্ষতা আছে, তারাই বর্তমান তথ্য ও সংখ্যা সম্পৃক্ত অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নতি করছেন।
বিশ্বে ২০২২ সাল নাগাদ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কাজের ক্ষেত্রে ১৩ কোটি নতুন কাজের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য একই সময়কালে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং নতুন প্রযুক্তির কারণে ৭ কোটি কাজ লুপ্ত হয়ে গেছে।
নতুন যেসব কাজের জন্য বেশি চাহিদা লক্ষ্য করা গেছে, তার মধ্যে আছে উপাত্ত, বিজ্ঞানী ও বিশ্লেষক; ই-বাণিজ্য এবং সামাজিক মাধ্যম বিশেষজ্ঞ; প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী ব্যবস্থাপক; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ। সন্দেহ নেই যে, নতুন এক ধরনের মানবসম্পদ প্রয়োজন হবে আগামী পৃথিবীর কর্ম জগতে।
এ লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাচ্ছে নানান দেশ। পরিশীলিত করছে শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠ্যসূচি, শিক্ষণ পদ্ধতি। জোর দিচ্ছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে। ইংরেজিতে এটাকে বলা হচ্ছে STEM (Science, Technology, Engineering and Medicine)।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা সনদ নিয়ে বের হচ্ছেন, তাদের মধ্যে STEM স্নাতক ৪০ শতাংশ। ভারতে এই সংখ্যা ৩০ শতাংশ। আজকের দিনে মানবসম্পদ গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনটা দক্ষতার ওপরে জোর দেওয়া হচ্ছে—তিনটা 'C'—cognitive skill (জ্ঞানের দক্ষতা), communication collaboration (যোগাযোগ সহযোগিতা) এবং coordination (সমন্বয়)। সামগ্রিক দক্ষতা অর্জনে এসব দক্ষতা এক ধরনের নমনীয়তা দেবে, যাতে এক পেশা থেকে অন্য পেশায় ন্যূনতম আয়াসেই চলে যাওয়া যায়।
বলা বাহুল্য, আগামী দিনের কর্মজগৎ এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে এইসব চালচিত্র বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। আজকের বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়কালে এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে।
ভবিষ্যৎ সময়ে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে শুধুমাত্র দেশে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করলে চলবে না, তাদের বিশ্বের অন্যান্য তরুণদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হবে। সুতরাং সে লক্ষ্যে নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর ওপরে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন—
প্রথমত: দেশের এবং দেশের বাইরের কাজের জগতে কী ধরনের কাজের সুযোগ আগামী দিনগুলোয় তৈরি হতে পারে, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করা। এই প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের আপাতনকে মনে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সেইসব কর্ম সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন হবে, তা চিহ্নিত করা।
দ্বিতীয়ত: বর্তমানে বাংলাদেশে কী দক্ষতা তৈরি হচ্ছে, তার একটি প্রতিবেদন তৈরি করা। সেই দক্ষতা এবং উপযুক্ত সুযোগের ক্ষেত্রে কোথায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করা। এ কাজটি করার সময়ে দেশের উদ্যোক্তাদের শ্রম চাহিদা এবং বহির্বিশ্বের শ্রম প্রয়োজনকে মাথায় রাখতে হবে।
দুইয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি মানব সম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং সে পরিকল্পনাকে দেশের সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
তৃতীয়ত: দেশের শিক্ষা কাঠামোর—শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠ্যসূচি, শিক্ষণ পদ্ধতির একটি সমীক্ষা প্রস্তুত করা। সে সমীক্ষার লক্ষ হবে দেশের শিক্ষা কাঠামো উপরোক্ত মানবসম্পদ পরিকল্পনার কোন ক্ষেত্রে শ্রম চাহিদা মেটাতে অক্ষম তা নির্ণয় করা। সে চালচিত্রের আলোকে পুরো শিক্ষা কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। সে কাঠামোতে তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হবে।
এ কাঠামো প্রণয়নে একদিকে যেমন বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের দিকে নজর রাখতে হবে, তেমনি অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা এবং অর্জনকে সামনে রেখে সেখান থেকেও শিক্ষণীয় বিষয়গুলো শিক্ষা কাঠামোয় প্রবিষ্ট করতে হবে।
চতুর্থত: মানবসম্পদ উন্নয়নকে কার্যকর করতে শিক্ষালব্ধ জ্ঞান, দক্ষতাকে আধুনিক সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিরন্তরভাবে করা প্রয়োজন। এ জাতীয় প্রশিক্ষণ দেশের শ্রমশক্তিতে যারা আছেন, তাদের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার শিক্ষক এবং প্রশিক্ষকদেরও। প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও পন্থা ও উপকরণ দ্রুত বদলাচ্ছে। তাই, এ ক্ষেত্রেও বহির্বিশ্বের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অত্যন্ত কার্যকর একটি ভূমিকা রাখতে পারে।
পঞ্চমত: মানবসম্পদ উন্নয়নের উপযুক্ত কাঠামোর নিয়মিত পরিবীক্ষণ, নিবিড় নিরীক্ষণ এবং বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের প্রয়োজন। এ সবকিছুর ভিত্তিতে সময় থেকে সময়ান্তরে সেই মানবসম্পদ কাঠামোর পর্যালোচনা করা দরকার। সে পর্যালোচনার আলোকে সেই কাঠামোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিশীলন দরকার হতে পারে।
কারণ, পৃথিবী বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে সমাজ ও মানুষ, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা, বদলে যাচ্ছে মানবসম্পদের চাহিদা ও জোগান। সেই পরিবর্তিত সময়ে বাংলাদেশ যেন তার এক এবং অনন্য সম্পদ—মানব সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করতে পারে। আমাদের উন্নতি এবং অগ্রযাত্রার এটি একটি অন্যতম চাবিকাঠি।
লেখকঃ ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)