রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
এক প্রশ্নের জবাবে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আমাদের কাজ চোর ধরা না, চুরির বর্ণনা দেওয়া। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং চুরির প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কারও কিছু বলার থাকলে দুদক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে যাওয়াই শ্রেয়।’
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১ থেকে ২.৮০ লাখ কোটি টাকা) রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাজেট বাড়ানোর মতো বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে। এতে বলা হয় রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীর করেছে। ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত।
দুর্নীতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায়নি। জীবনযাত্রার মানও হয়েছে নিম্নগামী। সরকারের আমলে সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মহোৎসব চলতে দেখা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকারের মতো খাতে দুর্নীতির ফলে মানুষের হয়রানির অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা খাতে উন্নতি খুবই নগণ্য এবং এখনো সর্বোচ্চ উদ্বেগজনক অবস্থায়ই রয়েছে।
রাজনৈতিক দল, জনপ্রতিনিধি, সরকার ও সরকারের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রাখতে পারে। ক্ষমতার উৎস যে জনগণ, তা যেন সরকার ও জনগণ ভুলে না যায়। এর জন্য গবেষণালব্ধ তথ্য ও বিশ্লেষণভিত্তিক প্রচারণা ও চাহিদা জোরদার করার সামাজিক আন্দোলনটি টিআইবিকে করে যেতে হবে এমন একটা সময় পর্যন্ত, যখন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যাদের হাতে তারা তাদের যথাযথ ভূমিকা কার্যকরভাবে পালন করবেন।
দুর্নীতি প্রতিরোধে শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে আমাদের একতাবদ্ধ হওয়া খুবই জরুরি। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতিতেও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
যদি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। দুর্নীতির অভিযানকে সফল করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ-উদ্যমকে একযোগে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবুও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। সরকার, বেসরকারি সংস্থা, মিডিয়া এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
যদি সংঘবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদকে ১৬টি পরামর্শ দিয়ে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল। হাইকোর্টের ১৬ পরামর্শ—
১. দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস গঠন করা। যে প্রক্রিয়ায় এবং যে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগ প্রদান করা হয় সেরূপ প্রক্রিয়ায় এবং সে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দুদকের কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান করা।
২. দুদকের অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও পৃথক, স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন নিয়োগ বোর্ড গঠন করা।
৩. দুদকের কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর কমিশনে যোগদান করার সময় তাদের সম্পদের বিবরণ দাখিল করা এবং প্রতি বছর বাধ্যতামূলকভাবে সম্পত্তির হিসাব জনসমক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা।
৪. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্যে থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণের মধ্যে থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্য নির্বাচন করা।
৫. সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীদের সমন্বয়ে উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতের জন্য পৃথক প্রসিকিউশন প্যানেল গঠন করা এবং প্রতি ৩ (তিন) বছর পর পর উক্ত প্যানেল পুনর্গঠন করা। উক্ত প্রসিকিউশন প্যানেলে আইনজীবী মনোনয়নের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বোর্ড গঠন করা। প্রসিকিউশন প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত আইনজীবীদের জন্য যুগোপযোগী সম্মানী ও অন্যান্য লজিস্টিক সার্পোটের ব্যবস্থা করা।
৬. কোনো ব্যক্তি থেকে গৃহীত দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিশন কর্তৃক তা অনুসন্ধান/তদন্তের জন্য গ্রহণ করা হলে অভিযোগকারীকে ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে অনুসন্ধানের ফলাফল এবং অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়েরের ১৫ (পনেরো) দিনের মধ্যে মামলার এজাহারের কপিসহ অভিযোগকারীকে অবহিত করা।
৭. কোনো ব্যক্তি থেকে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রহণ করা না হলে কিংবা অনুসন্ধানে সেটার সত্যতা পাওয়া না গেলে কিংবা তদন্ত করে সত্যতা না পেলে কিংবা কমিশন কর্তৃক অনুসন্ধানের/মামলা দায়েরের/তদন্তের অনুমোদন প্রদান করা না হলে তার কারণ উল্লেখ করে প্রতিটি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে অভিযোগকারীকে অবহিত করা।
৮. কোনো ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনে বা তার কোনো স্থানীয় কার্যালয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রদান করলে সে কার্যালয় ওই অভিযোগ গ্রহণের কোনো স্বীকৃতিপত্র বা রশিদপত্র প্রদান না করলে কিংবা সে অভিযোগ গ্রহণ করা না হলে কিংবা অনুসন্ধান করে অভিযোগকারীকে ফলাফল অবগত করা না হলে কিংবা অনুসন্ধানের ফলাফলে তিনি সংক্ষুব্ধ হলে অভিযোগকারী কর্তৃক এ বিষয়ে হলফনামাসহ কারণ উল্লেখপূর্বক অভিযোগটি অপরাধ সংঘটনে সংশ্লিষ্ট জেলার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দায়ের করা।
৯. দুর্নীতি দমন কমিশনে কর্মরত কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের নিকট বা তার স্থানীয় কার্যালয়ে আনলে কমিশন তা অনুসন্ধান করে সত্যতা না পেলে কিংবা সত্যতা পেয়েও কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমোদন প্রদান না করলে কিংবা কমিশনের সিদ্ধান্তে অভিযোগকারী সংক্ষুব্ধ হলে অভিযোগকারী পূর্ব বর্ণিত বিধি মোতাবেক অবহিত হওয়ার পর বা তাকে আদৌ অবহিত করা না হলে অভিযোগ দাখিলের পরবর্তী ১৮০ (একশত আশি) দিন পর ওই অভিযোগকারী সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি দমন কমিশনে কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জেলার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।
এ ক্ষেত্রে সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা কর্তৃক তদন্ত ব্যতীত উক্ত অভিযোগ সরাসরি আমলে গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে এই তদন্তের দায়িত্ব কোনো অবস্থাতেই দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা তার কোনো কর্মকর্তাকে প্রদান করা যাবে না। এই তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফৌজদারি মামলার তদন্তের বিদ্যমান আইনের সব ক্ষমতা ও এখতিয়ার প্রয়োগ করবেন।
১০. দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষ জজ নিয়োগ প্রদান করা। বিশেষত প্রত্যেক জেলায় মামলার সংখ্যার অনুপাতে এক বা একাধিক বিশেষ জজ নিয়োগ দেওয়া এবং উক্ত আদালত ও বিচারকের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করা। বিশেষ জজ আদালতকে পুনর্গঠন করে তা দ্রুত বিচার নিষ্পত্তিতে সক্ষম করে তোলার উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনালে রূপান্তর করে ‘দুর্নীতি দমন ট্রাইব্যুনাল’ নামকরণ করা।
১১. দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য নির্ধারিত পদসমূহে কমিশনের বাইরের কোনো কর্মকর্তাকে পদায়ন না করা।
১২. দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধানের বিষয় ও ফলাফল মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক পর্যায়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করা। তাছাড়া দুর্নীতিবাজ কোনো ব্যক্তির দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের ফলাফল কিংবা তার সম্পত্তির তালিকা বাধ্যতামূলকভাবে কমিশন কর্তৃক জনগণকে অবহিত করা। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওয়েবসাইটে ধারাবাহিকভাবে এসব তথ্য প্রকাশ করা।
১৩. যেকোনো তথ্যের জন্য কোনো ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনে বিধি মোতাবেক দরখাস্ত করলে তাকে দরখাস্ত প্রদানের ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে ফলাফল অবহিত করা। সেক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ অনুসরণ করার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া।
১৪. দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ১৭ (ক) ধারার আওতা ও পরিধি বৃদ্ধি করা এবং ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ১৯৮৬ (জুলাই, ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত)-এ বর্ণিত ১ থেকে ২৫ নং টেবিলে বর্ণিত (সাংবিধানিক দায়মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত) ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে তফসিল বর্ণিত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা’ সংক্রান্ত বিধান সংযুক্ত করা।
১৫. দুর্নীতি বিষয়ক প্রতিটি অনুসন্ধান এবং তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করা।
১৬. উপরে বর্ণিত দফাসমূহ বাস্তবায়ন / কার্যকরী করার জন্য The Code of Criminal Procedure, 1898; দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪; দুর্নীতি কমিশন বিধিমালা, 2009; Criminal Law Amendment Act, 1958; Prevention of Corruption Act, 1947; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯; অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইন, ২০১২ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধিসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা।
পরিশেষে বলছি, আমরা সবাই মিলে দুর্নীতিবাজদের সম্মিলিতভাবে ঘৃণা করলে এবং তাদের কঠোর হস্তে প্রতিহত করতে পারলে দুর্নীতি কমে যাবে। আসুন সবাই চেষ্টা করি নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ হিসেবে উপস্থাপন করি।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার হাইকোর্টের দেওয়া ১৬ পরামর্শ সঠিকভাবে গ্রহণ করলে দুর্নীতি কমে যাবে। সর্বোপরি, দুর্নীতি প্রতিরোধে যা কিছু করণীয়, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখকঃ কলামিস্ট ও চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরার সভাপতি। সাবেক ট্রাস্টি, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)