বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
৮ জানুয়ারি ২০২৫। দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি এবং আফগান তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির মধ্যে বৈঠক হয়। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবানদের আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর এটাই ছিল দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক এবং তা প্রকাশ্যে বেশ ঘটা করেই তা অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে ভারত আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে। এ বৈঠক থেকে প্রতীয়মান হয় অবশেষে ভারত পূর্বের নীতি থেকে সরে গিয়ে এখন তালেবান সরকারের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার অবস্থান নিয়েছে। এটা এশিয়ার রাজনীতিতে বড় এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। একে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে ভারতের ডিগবাজি বলা যেতে পারে। আসলে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য আফগানিস্তানকে ভারতের ভীষণ প্রয়োজন।
২০০১ সালের অক্টোবরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট আফগানিস্তান দখল করে এবং তালেবান সরকারকে উৎখাত করে সেখানে তালেবান বিরোধী হামিদ কারজাইয়ের সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। তখন ভারত প্রথম দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের সেই সরকারকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়েছিল। আফগানিস্তান ইস্যুতে ভারত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সহযোগী দেশ।
আফগানিস্তানে তিন বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে ভারত। কিন্তু ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বশেষ সৈন্য প্রত্যাহার করলে ভারত ভীষণ নাখোশ, হতাশ ও বিচলিত হয়ে পড়ে। সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে কয়েক বছর আগে থেকেই মার্কিন-তালেবান আলাপ-আলোচনা চলে। সে সময় ভারত নির্বাক দর্শকের মতো সাইড লাইনে বসে থাকতে বাধ্য হয়।
এক পর্যায়ে আফগান সংকট নিরসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া মিলে ট্রয়কা (European troika) আলোচনা ফোরাম গঠিত হয়। তিন ঘোড়া মিলে টেনে নেওয়া গাড়ি হলো ট্রয়কা। সেই ট্রয়কা আলোচনায় পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিনিধিদের ডাকা হয়। কিন্তু সেখানেও ভারত উপেক্ষিত থাকে। এমন নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়েই ২০ বছর পর ভারত শেষ পর্যন্ত শূন্য অর্জন নিয়ে বাড়ি ফেরে।
আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলকে ভারত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। পানশির উপত্যকায় তাজিক নেতা আহমেদ মাসুদের অনুগত যোদ্ধারা তালেবানদের বিরুদ্ধে ছোটখাটো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ভারতীয় মিডিয়া আহমেদ মাসুদের বাহিনীর সামান্য প্রতিরোধকে ফুলে ফেঁপে বিরাট আকারে প্রচার করতে থাকে। ভারতীয় মিডিয়ায় আহমেদ মাসুদকে আফগান নেপোলিয়ন খেতাবে ভূষিত করে প্রচার করা হয়।
পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আফগানিস্তান ও তালেবানদের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়া শুরু করে বিরাট প্রোপাগান্ডা। তবে সব বাধা অতিক্রম করে তালেবানরা এক মাসের মধ্যেই পানশিরসহ সমগ্র আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু তারপরও ভারত আশায় থাকে যে তালেবান সরকার টিকে থাকতে পারবে না। এ কারণে ভারত তালেবান সরকারের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে। জঙ্গিবাদের নয়া উত্থান সম্পর্কে ভারত মহাবিপদ সংকেত জারি করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। কিন্তু তাতে মার্কিনিরা আর আগের মতো সাড়া দেয় না।
ভারতের কূটনীতিক, একাডেমিক এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা আফগানিস্তানের নতুন বাস্তবতা (রিয়ালিটি) মেনে নেওয়ার জন্য নরেন্দ্র মোদিকে পরামর্শ দেন। ভারতের দ্য প্রিন্ট পত্রিকার সম্পাদক শেখর গুপ্তা পরামর্শ দেন, লাইক দেম অর নট, তালিবান আর এ্যা রিয়ালিটি। ইন্ডিয়া ক্যান ডিল উইথ দেম ইফ বিজেপি রিসেটস ইটস পলিটিক্স (Like them or not, Taliban are a reality. India can deal with them if BJP resets its politics)। অর্থাৎ পছন্দ করুন আর নাই করুন, তালেবানরা হলো বাস্তবতা। বিজেপি যদি তার রাজনীতিকে পুনর্গঠিত করে তাহলে ভারত তাদের সাথে বোঝাপড়া করতে পারবে। (দ্য প্রিন্ট, ২৪ জুলাই ২০২১)।
তবে মোদি-জয়শঙ্কর এ পরামর্শ কানে তোলেননি। ভারতের রাজ্যসভায় জয়শঙ্কর বলেছিলেন, আফগানিস্তানে বল প্রয়োগের সরকার ক্ষমতা দখল করলে অর্থাৎ তালেবানরা ক্ষমতা দখল করলে ভারত তা মেনে নেবে না। পরবর্তীতে তালেবানরা চূড়ান্তভাবে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করলে ভারত ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ নীতি অবলম্বন করে। কাবুল ও নয়া দিল্লিতে অবস্থিত পরস্পরের দূতাবাস কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দিনে দিনে তালেবান সরকার তাদের অবস্থান সুসংহত করে এবং আফগানিস্তান স্থিতিশীলতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
চীনের সাথে তালেবানদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। ২০২৪-এর ৩০ জানুয়ারি বেইজিংয়ে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত আসাদুল্লাহ বেলাল করিমির পরিচয়পত্র প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গ্রহণ করেন। যা ছিল মূলত তালেবান সরকারকে চীনা স্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ। চীন-তালেবান ঘনিষ্ঠতা ভারতকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে।
২০২৪-এর ১০ ডিসেম্বর রাশিয়ার পার্লামেন্ট ডুমায় তালেবানকে নিষিদ্ধের তালিকা থেকে অবমুক্ত করার আইন পাস হয়। এর কয়েকদিন পর ২৩ ডিসেম্বর সৌদি আরব পুনরায় আফগানিস্তানে তার দূতাবাস খোলার ঘোষণা দেয়। এভাবে তালেবান সরকারের বৈদেশিক স্বীকৃতি লাভের দুয়ার উন্মোচিত হওয়ার ঘটনাক্রমে ভারত পেছনে পড়ে থাকতে চায়নি। যার ফলশ্রুতিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি কালবিলম্ব না করে আফগান তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাথে দুবাইয়ে বৈঠক করেন।
এশিয়া হয়ে পড়েছে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব খেলার কেন্দ্রবিন্দু। কেননা এশিয়ার দেশ চীন হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। চীন-মার্কিন দ্বৈরথের কারণে এশিয়ায় ক্ষণে ক্ষণে বন্ধু বদলের পাশাপাশি শত্রু বদলও ঘটে চলেছে। দুনিয়া আর আগের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগের অবস্থায় নেই। যেখানে দেখা যেত এক ঝাঁক দেশ চোখ বন্ধ করে মার্কিন কিংবা সোভিয়েত বলয়ে ঢুকে পড়ছে।
বর্তমান দুনিয়ায় বিভিন্ন রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতিমালা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও জটিল প্রকৃতির। শত্রুগণ্য দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ চললেও বাণিজ্যিক যোগাযোগ ঠিকই চালু থাকে কিংবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না। অর্থাৎ বর্তমান দুনিয়ায় ভূ-রাজনীতির (জিওপলিটিক্স) চেয়ে ভূ-অর্থনীতি (জিওইকোনমিক্স) আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৪-এর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডার জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা অতিরঞ্জিত করে প্রচারের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা জঙ্গিবাদীদের দখলে চলে যাওয়ার বানোয়াট গল্পও প্রচার করে।
বাংলাদেশের মানুষ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, সামনের দিনগুলোয় জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে যদি সেভাবেই ঐক্য ও সংহতি প্রদর্শন করে, তবে সব বিদেশি প্রোপাগান্ডা ব্যর্থ হয়ে পড়বে। আগামীর দুনিয়ায় জঙ্গিবাদ জুজুর ভয় দেখিয়ে স্বার্থসিদ্ধির কৌশল ক্রমান্বয়ে অলাভজনক হয়ে পড়বে।
২০২৪-এর ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে এইচটিএস বা হায়াত তাহরির আল শাম সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অনেক নেতা ও যোদ্ধারা এককালে জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সাথে যুক্ত ছিলেন। আল কায়দার সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে এইচটিএস নেতা গোলানির মাথার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিন্তু গোলানি ও তার দল সিরিয়ার ক্ষমতায় বসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই পুরস্কারের ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এখন নতুন এই সিরীয় সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে চলেছে। এটাই হলো ভূ-রাজনীতির মহাখেলা বা গ্রেট গেম যার নেপথ্যে লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক কার্যকারণ। আর এমন খেলার নিয়ম-নীতি ও খেলোয়াড়রা দ্রুতই পরিবর্তনশীল। যারা পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে নিজেদের দ্রুতই খাপ খাওয়াতে পারে তারাই সফলভাবে টিকে থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে বিশ্ব পরাশক্তি হয়ে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ সে নিজেকে কয়েক বছর পর পর দ্রুতই পরিবর্তন করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র তার পূর্বেকার কর্মকাণ্ডকে যথাযথভাবে পুনর্মূল্যায়ন বা রিভিউ করে। কিন্তু ভারত ২০ বছর যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রকে জাপটে ধরে থাকলেও এই কৌশলটা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্র এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় জনপ্রিয় শাসকদের ক্ষমতায় দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিবর্তিত নীতি চীন ঠেকানোর কৌশলের অংশ। যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর চীন ঠেকানোর ভারতকে যে দায়িত্ব দিয়েছিল ভারত তা যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মার্কিন সুবিধার অপব্যবহার করে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর নিজের পছন্দের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভারতের এই আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্র নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কাম্য ছিল না। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারত ও চীনের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় গণতান্ত্রিক শক্তির উত্তরণ। এমতাবস্থায় পড়শি দেশগুলোর ওপর ভারতের চোখ রাঙানির প্রভাব অকার্যকর হয়ে পড়বে।
জুবায়ের হাসান ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)