মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১
জিনিসপত্রের মূল্য বাড়াটা শুকনো অর্থনীতির বিষয় নয়, বিষয় নয় শুধু আর্থিক 'হিসাবয়নের'। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ, না ১০ শতাংশ, তা নিয়ে তর্কের কি কোনো মানে আছে সেই মানুষদের কাছে, যাদের সংসার চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে গেছে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে?
কত ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে জিনিসপত্রের মূল্য বাড়ার, কত ব্যবস্থার কত কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কী আসে যায় সে সব বিশ্লেষণের যারা একটু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন? আসলে কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্ব দিয়েই চলমান বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। দরদাম বৃদ্ধির কোনো ব্যাখ্যাই তো কাজ করছে না সামষ্টিক বা ব্যষ্টিক পর্যায়ে।
শঙ্কার কারণ বহুবিধ। বিভিন্ন রকমের চালের দাম বাড়ছে। আমাদের জনসংখ্যার একটা বড় অংশই বাজার থেকে চাল কিনে খায়। বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগামীতে বোরো মৌসুমে কৃষির উপকরণ সহজ লভ্য না হলে চালসহ নানান কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। শঙ্কার কারণ রয়েছে অন্যত্রও। সাধারণ মানুষের সহজতর আমিষের উৎস হচ্ছে ডিম। কিন্তু এখন প্রতিটি ডিমের মূল্য প্রায় এক বোতল পানির কাছাকাছি। শ্রমজীবী মানুষ সকালের নাস্তা খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
দাম কমানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, টাকা ছাপিয়ে ব্যয় মেটানো হবে না, যদিও পরে ব্যয় মেটাতে টাকা ছাপাতেই হয়েছে। সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, ঋণ উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, নানান গোষ্ঠীদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে ‘কঠোর ব্যবস্থার’ কথা বলে। সরকার খোলা বাজার ব্যবস্থায় ট্রাকে করে শাকসবজি বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির অশ্বকে বাগ মানানো যাচ্ছে না।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ উচ্চমূল্যের শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির সংযোগ নেই। উন্নত বিশ্বে যুক্তরাজ্যে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৩ শতাংশ, কানাডায় ১ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ভিন্ন অন্য সব দেশের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে কম।
দুই বছর আগেকার সংকট কাটিয়ে শ্রীলঙ্কা তার ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে বর্তমান সময়ে ১ শতাংশের নিচে কমিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যহ্রাস হয়নি। দরদামের এই বাড়তির সময়েই ১০০টির মতো পণ্য এবং সেবার ওপরে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
মনে রাখা দরকার যে, 'মূসক' বাড়ছে এমন একটা সময়ে যখন বাংলাদেশ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি অত্যন্ত উঁচু এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৩ শতাংশ এবং সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার ১১ শতাংশ। সেই সঙ্গে ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১.৮ শতাংশ—১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নতম।
এটা সর্বজন বিদিত যে নতুন করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের দেওয়া শর্ত পূরণ করার জন্যে।
মোট ৪৫০ কোটি ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই কর-জাতীয় দেশজ উৎপাদনের অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের। তার মানে টাকার অঙ্কে ১২ হাজার কোটির বেশি রাজস্ব জোগাড় করতে হবে সরকারের। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের জন্যে এমন শর্ত তো নতুন কিছু নয়।
নানান মহলে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে যে, নতুন করে 'মূসক' আরোপণের ফলে দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তেমনটা হবে না। তাদের মতামতের পক্ষে অন্ততপক্ষে দুটো যুক্তি দেখানো হচ্ছে।
যে সব পণ্য বা সেবার ওপরে 'মূসক' বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো 'ভোগ্যপণ্য মূল্য সূচকে' অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং সে সব পণ্যের ওপরে বর্ধিত করে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। এটি সত্যিকার অর্থে একটি বাস্তবতা বর্জিত কথা। দু'একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ। পোশাক সব ধরনের মানুষই কেনে—ধনী ব্যক্তিরা হয়তো ৫০০০ টাকার, সাধারণ মানুষ হয়তো। এর ওপরে বর্তমানে স্থিত 'মূসক' ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি করলে সাধারণ মানুষের পকেটের ওপরে চাপ পড়বে সন্দেহ নেই, ভোগ্যপণ্য মূল্য সূচকে সেটা প্রতিফলিত হোক বা না হোক।
মিষ্টি বিষয়েও সেই একই কথা। সুতরাং পূর্ব নির্ধারিত এ সব পণ্যের ওপরে 'মূসক' বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই, তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে, তা সেটা আঙ্কিক মূল্যস্ফীতির সমীকরণে ধরা পড়ুক কিংবা নাই পড়ুক।
'মূসক' বৃদ্ধি উৎপাদক এবং ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ডের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইতিমধ্যেই তৈরি পোশাক, রেস্তোরাঁ, মিষ্টি ব্যবসায়ীরা তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যদিও নানা মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে কিছু কিছু পণ্য এবং সেবার ওপরে আরোপিত 'মূসক' কমিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু তারপরেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে 'মূসকের' নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈকি।
ব্যবসায়ীদের এসব প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে যে, একদিকে 'মূসক' বাড়লেও অন্যদিকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসমূহের ওপরে শুল্ক শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু শূন্য শুল্কের সামগ্রী সমূহের মূল্য কমে যাবে, তাই 'মূসক' আরোপের কারণে মূল্যস্ফীতির ওপরে কোনো প্রভাব পড়বে না। সমস্যা হচ্ছে, যে সব পণ্যসামগ্রীর ওপরে শুল্ক শূন্য করে দেওয়া হয়েছে, তাদের দামও তো কমছে না।
সবটা মিলিয়ে বলা চলে 'মূসক' বৃদ্ধির কারণে একাধিক পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে রোজার বেশি দেরি নেই। ঐতিসাহিকভাবেই রোজার সময়ে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যায়। 'মূসক' বৃদ্ধি অবস্থাকে আরও খারাপ করে দেবে বলে শঙ্কা জাগে।
সরকারের রাজস্ব-আয় বাড়ুক, এটা অত্যন্ত কাম্য। কিন্তু 'মূসকের' মতো অপ্রত্যক্ষ করই কি সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা? সবাই বলছেন যে, বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করের বলয় আরও বিস্তৃত করা দরকার। বাংলাদেশে কর-জাতীয় দেশজ পণ্যের অনুপাত ৮ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সেটা ১২ শতাংশ, নেপালে ১৭ শতাংশ।
এশীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোয় এই অনুপাত ১৯ শতাংশ, উন্নয়নশীল বিশ্বে ২৫ শতাংশ। সুতরাং রাজস্ব আহরণের জন্যে বাংলাদেশকে তার কর জাতীয় দেশজ পণ্যের অনুপাত বাড়াতে হবেই। এবং সেটা করতে হবে প্রত্যক্ষ করের আওতা এবং পরিমাণ বাড়িয়ে।
প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির আরেকটি দিক আছে। বিগত দিনগুলোয় ধনিক শ্রেণির ওপরে আয় করের তুলনায় সাধারণ মানুষের ওপরে শুল্ক ও 'মূসকের' মতো অপ্রত্যক্ষ কর বেশি বসিয়ে রাজস্ব আহরণ করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এতে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজকে বাংলাদেশ যখন একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশী, তখন সাধারণ মানুষবান্ধব নয় এমন কাঠামোর পরিবর্তন অত্যাবশ্যকীয়। মনে রাখা প্রয়োজন, যেখানে ভারতের মতো দেশে ৫৯ শতাংশের বেশি কর আহরণ করা হয় প্রত্যক্ষ কর থেকে, সেখানে বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশ কর আসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপরে শুল্ক এবং 'মূসক' থেকে।
কর ফাঁকি রোধ করে এবং কর প্রশাসনের উন্নতি করেও রাজস্ব-আয় বাড়ানো যায়। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকির কারণে বছরে সরকারের প্রায় ৫৬ হাজার কোটি থেকে প্রায় ৩ লাখ কোটি পর্যন্ত রাজস্ব আয় কম হয়। নানা ধরনের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই কর ফাঁকি রোধ করা যায়।
চূড়ান্ত বিচারে বলা যায় যে, নতুন করারোপ বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। এ সব অতিক্রম করার জন্যে সংস্কার প্রয়োজন কর কাঠামোয় এবং কর আদায় ব্যবস্থায়। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং বৈষম্য কমাতে এর বিকল্প নেই।
ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)