বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১


নারীর অগ্রগতি : চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

ওয়ারেছা খানম প্রীতি

প্রকাশিত:৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:৩২

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

হাইপেশিয়ার কথা আমরা অনেকেই জানি। জানি জোয়ান অব আর্কের কথাও। নারী তিনি পশ্চিমের হন কিংবা প্রাচ্যের; সবার ক্ষেত্রে একইরকম ভাগ্যলিপি লেখা থাকে। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের কেউই সেই ভাগ্যলিপি খণ্ডন করতে পারেনি। তাইতো পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘটুক না কেন নারীর প্রতি সহিংস ঘটনার বর্ণনা আমাদের চিরচেনা লাগে।

এই যে আমরা নারী শিক্ষা নিয়ে এখন এত সোচ্চার কিন্তু দিনশেষে দ্বিতীয় লিঙ্গের তকমা ঘাড়ে নিয়েই নারীদের চলতে হয়। শুধু নারী বলেই নিজের হাজারও যোগ্যতার সাথে কম্প্রোমাইজ করে কখনো তাকে পরিবার আবার কখনো সমাজের অহেতুক ও অকেজো মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়।

নতুন কিছু না, ঘটনার সূত্রপাত পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই কিংবা বলা যায় মানব সভ্যতার শুরু থেকেই। যুগে যুগে জন্ম নিয়েছে জ্ঞানের দ্যুতি ছড়ানো বিদুষী নারী। খুব যৌক্তিক কারণে তাদের দমিয়ে রাখা হয়েছে। কখনো বল প্রয়োগ করে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

৪০০ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে জন্ম নেওয়া ইতিহাস স্বীকৃত প্রথম নারী গণিতবিদ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, নিউপ্ল্যাটোনিজমের প্রবর্তক এবং আলেকজান্দ্রিয়ান লাইব্রেরির সর্বশেষ গবেষক হলেন হাইপেশিয়া। বিশ্বাস করা হয় যার মৃত্যুর পর মিশরের জ্ঞানের আলো নিভে গিয়েছিল প্রায় এক হাজার বছরের জন্য। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া অবধি জীবন্ত অবস্থায় তার শরীরের মাংস খুবলে ফেলা হয়। নারী শিক্ষা অপ্রয়োজনীয় জিনিস। নিজেকে দক্ষ রূপে প্রকাশ করা ছিল নারীর জন্য অপরাধ।

জোয়ান অব আর্ক ইতিহাসে যাকে বর্ণিত করা হয়েছে একাধারে বীরযোদ্ধা, সেনাপতি ও বিপ্লবী হিসেবে। হন তিনি ফ্রান্সের কিন্তু সেই সমাজও নারীকে এমন পরাক্রমশালী দেখতে প্রস্তুত নয়! তার বীরত্বগাঁথা নিশ্চিহ্ন করতে ১৪৩১ সালে জনসম্মুখে পুড়িয়ে মারা হয়। সেই জোয়ান অব আর্ককেই ১৮০৩ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করেন।

নারীর শিক্ষাকে, নারীর অগ্রগতিকে দেশের সম্পদ হিসেবে প্রচার করতে থাকেন তিনি। তার উচ্চারিত ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো’ বাক্য সত্যিকার অর্থেই নারী শিক্ষা বিস্তারে পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সময় গড়িয়েছে। পাল্লা দিয়ে সমাজ এগিয়েছে।

রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা পাল্টেছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা ঘোচানো সম্ভব হয়নি। কারণ এতে প্রচ্ছন্ন সায় থাকে রাষ্ট্রের। এই ব্যর্থতা রাষ্ট্রের লালিত। রাষ্ট্র বলছে, নারী শিক্ষা জরুরি, নারীর কর্মসংস্থান জরুরি, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা জরুরি কিন্তু পরক্ষণেই নারীকে হতে বলছে পরিবারের প্রতি অনুগত, পতিব্রতা, ঘরকন্যায় পারদর্শী, সমাজের চোখে সুনিপুণা।

কন্যাকে পিতামাতা শিক্ষিত করে গড়ে তুললেও সমাজের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা ধাপে ধাপে তার কণ্ঠ রোধ করার উপায় বলে দেয়। অনেকটা এমন—সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো। এত এত উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের চারপাশে! বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা অনেকেই রুমানা মঞ্জুর নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী অধ্যাপকের কথা জানি, যিনি স্বামীর নির্যাতনে দুই চোখ হারিয়েছিলেন।

তার মানে কেবল শিক্ষা নিশ্চিত হলেই যে নারীর দৈন্যতা ঘুচবে ব্যাপারটা তেমন নয়। সেক্ষেত্রে জাতির দৈন্যতা নিরসন কোন জন্মে সম্ভব সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে নারীর জন্য নারীবান্ধব যে পরিবেশ দরকার নিজেকে বিকশিত করার জন্য সেটা করতে না পারার দায় যতটা না সমাজের তারচেয়ে অনেকখানি বেশি রাষ্ট্রের।

কেন বলছি? সাপ আর ওঝার সূত্র বসিয়ে এই বীজগণিত অঙ্ক আপনাকে সমাধান করতে হবে। ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব যখন নারী বাইরের প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন কোনোরকম বাধা বা সীমাবদ্ধতায় প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের শিক্ষা, কর্মজীবন এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে পারবে।

মজার ব্যাপার হলো, নারী ও পুরুষের মৌলিক অধিকার সমান ও অভিন্ন। অন্তত কাগজে কলমে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বে যেভাবে নারীদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত ও নিশ্চিত করা হচ্ছে ততটা না করলেও বাংলাদেশ একটা প্রারম্ভিক পর্যায়ে আছে।

বাঙালি নারী শিক্ষার অগ্রদূত ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ। তাদের পরিশ্রমের প্রতিফলন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ক্রমান্বয়ে ভোগ করবে। হয়তো আমাদের অনেকেরই নানি, দাদি পড়ালেখার সুযোগ পায়নি। হয়তো না, এটাই সত্যি।

এর পরের প্রজন্মে এসে আমাদের মা, খালা, ফুপুরা পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী একটা দেশ। ডিজিটালাইজেশনের এই সময়ে এসে আমরা মায়েদের থেকে অনেকখানি বেশি সুবিধা ভোগ করতে পারছি। ঠিক এখান থেকেই পরবর্তী প্রজন্মের পরিবর্ধনের জায়গা খুঁজতে হবে।

যেকোনো দেশে বসবাসরত নাগরিকের শ্রেণিভেদ থাকে। শহুরে জনগোষ্ঠীর সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে অনেক পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্য ঘোচানোও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেকোনো দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো সেই দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ।

দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক হতে পারে কিন্তু নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়নের সাথে দেশের সার্বিক উন্নয়ন জড়িত এই বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে কিছু বিষয় থাকে যেখানে কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের বা আঙুল তোলার সুযোগ থাকে না। ভিন্নমত পোষণ করা যায় না। বৃহত্তর স্বার্থে এক হওয়া যায়।

নারীর মৌলিক অধিকারকে সত্যিকার অর্থেই অধিকারে রূপান্তর করতে চাইলে এমন ঐকমত্য থাকাটা প্রয়োজন। আমরা জানি রাষ্ট্রের পরিচালনার দায়িত্ব নির্দিষ্ট সময় পরপর রদবদল হয়। দেশের গণতান্ত্রিক আবহে এটাই স্বাভাবিক এবং মঙ্গলজনক। তবে সেই পালাবদলের সাথে সাথে যেন নারীর মৌলিক অধিকার খর্ব না হয় সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

নারী নিজে ছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র, বহির্বিশ্ব সবই পুরুষ কাঠামো। নিজের যোগ্যতার জায়গাটা লড়াই করেই নারীকে অর্জন করতে হয়। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভালো কোনো অর্জনকে বলা হয় সুন্দর চেহারার কারণে অর্জন। নারী যতই মেধাবী হোক, সেটার মূল্যায়ন পরে।

নারীর শারীরিক সৌন্দর্যকেই নারীর কোনো অর্জনের যোগ্যতা হিসেবে ভাবা হয়। দুর্মুখ সমাজ। নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াকে কয়েক ধাপে দেখা যেতে পারে। প্রথম ধাপ হচ্ছে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা এবং সেখান থেকে পারিবারিক বলয়ের মধ্যে নিজের মতপ্রকাশ করার ক্ষমতা অর্জন করা।

অন্য ধাপটি হচ্ছে সমাজ এবং জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মতপ্রকাশের ক্ষমতা অর্জন করা। সবশেষে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন। কথায় বলে টাকা কথা বলে। কথাটা কিন্তু সত্যি।

ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৫:২০ ভোর
যোহর ১২:১৩ দুপুর
আছর ০৪:১২ বিকেল
মাগরিব ০৫:৫১ সন্ধ্যা
এশা ০৭:০৫ রাত

বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫