সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১
ছবি সংগৃহীত
নারী একটা অবয়ব। সেই অবয়বকে নানাভাবে শেইপআপ করার প্রচেষ্টা চলে। যেহেতু সেই অবয়ব নিয়ে নানা মুনির নানা মত তাই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিশ্ব খুবই উদ্বিগ্ন। বিশ্ব আসলে কী? কারা প্রতিনিধিত্ব করে? পুরুষ জাতি তাইতো!
বিশ্ব নিজে আসলে পুরুষ। পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে বাস করা নারী খুবই অপ্রাসঙ্গিক অধিকার চর্চা করে থাকে। অর্থাৎ যেটুকু তাকে দেওয়া হয় সেটুকুই তার অধিকার। প্রতিবছরই নারী দিবসে ভিন্ন ভিন্ন থিমের মাধ্যমে নারীকে একধাপ ওপরে ওঠানোর প্রচেষ্টা করা হয়। যেহেতু সবাই খুবই উদ্বিগ্ন তাই তাদের প্রচেষ্টাকে বাহবাও দেওয়া যায়।
এভাবে বছর যায়, পরের বছর আরেকটা থিম আসে, এভাবেই থিমের ওপর থিম আসে। বিশ্বাস করতে চাই থিম বিষয়টার বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের দায়িত্ব নিশ্চয় কারো ওপরে আছে। অথবা হয়তো এটা শুধুই দিবসকেন্দ্রিক কার্যক্রম। পৃথিবীর চলমান ঔদ্ধত্যের সামনে নারীর অবস্থান স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায়ও নেই।
২০২৪ সালের থিম ছিল নারীর ওপরে বিনিয়োগ করো। খুবই ওভাররেটেড থিম। তারপরেও ‘দিবস রজনী, আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।’ আমি আসলে দিবসের আশাতেই থাকি। অন্তত ভালো কিছু বাক্য পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার মূল্য আসলে অনেক। আশা রাখি আরও কয়েক দশক পরে হলেও ইথারে বাক্যগুলো ভাসবে এবং যেটা ভবিষ্যৎ বিশ্ব তুড়ি মেরে উড়িয়ে না দিয়ে কিছুটা আদর আপ্যায়ন করবে।
একটু মনে করিয়ে দেই, এই যে ২০২৪ সালে নারী দিবসে সারা পৃথিবীকে জানানো হলো নারীর ওপরে বিনিয়োগ করো, তো সেটা কতখানি করা হলো! সব রকমের ব্যস্ততার রাশ টেনে আবার তো সেই নতুন বছর এসে গেল! সেইসাথে আবার নতুন করে সম্ভাবনাময় কিছু বাক্যরাশি।
সম্ভাবনার বিশ্বে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ সমাজের প্রতিটা স্তরে নারীর সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করা। কর্মস্থল ও সমাজে লিঙ্গসমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। নারীর ক্ষমতায়ন অর্থাৎ শিক্ষা, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর স্বনির্ভরতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সেইসাথে কর্মসংস্থান, বেতন বৈষম্য ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য হ্রাস করা।
ভীষণ সোজাসাপ্টা শব্দাবলী অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যাচ্ছে এই অংক মেলাতে। আমাদের পরিসংখ্যান খাত খুবই দুর্বল ন হয় মানুষ হিসেবে নারীর প্রতিদিনকার জার্নি যেটা মূলত বিশ্বের সব পুরুষের বিশ্বাস তাদের সহযোগিতা প্রবণতার কল্যাণেই নারী তার সব সুবিধা পাচ্ছে এবং খেয়ে পড়ে বেঁচে বর্তে আছে। তো প্রতিবছরের সেই প্রাপ্তির অগ্রগতি কিংবা অবনতির একটা পরিষ্কার চিত্র আমাদের কাছে থাকা উচিত ছিল। খুবই আফসোসের বিষয় তা আসলে নেই।
তবে কিছুক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবর্তন এসেছে। হয়তো ক্রমাগত বৈশ্বিক চেষ্টার ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। আস্তে আস্তে পরিবার সচেতন হয়েছে, এরপর সমাজ। নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দুই দশকে বেড়েছে। সেইসাথে নারীর ক্যারিয়ার বিস্ময়করভাবে বহুমুখী হয়েছে। চাকরির পাশাপাশি নারী স্বাধীনভাবে ব্যবসা করছে। এটা ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন এবং নারীর অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
আমরা শুনে শুনে এবং জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি নারীর জন্য স্কোপ তৈরি করে দেওয়া হয়। নইলে নারীর জন্য কাজ করা সহজ না। যদি কখনো সুযোগ হয় একজন ক্যারিয়ারে সফল নারীর সাথে ৩০ মিনিট গল্প করবেন। ১০ মিনিটের মাথায় সেই নারীই আপনাকে জানাবে তার স্বামী অনেক সাপোর্টিভ। স্বামী তাকে কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে বলে তিনি কাজ করে যেতে পারছেন। এই হলো অবস্থা!
সেই জায়গায় নারীরা এখন ব্যবসা করছে ভাবা যায়! এবং সেটা এক দুইজন না লাখে লাখে নারী! নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ব্যবসায় লাভ লোকসান ডিল করছে। কিছুক্ষেত্রে যে পরিবারের হস্তক্ষেপ নেই সেটা অস্বীকার করা যাবে না তবে বেশিরভাগ নারীরা নিজেরাই নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করছে।
কর্মসংস্থান কিংবা ক্ষমতায়নের জায়গা থেকে আমি নারীদের বিজনেস সেক্টরকে সমাদর করছি কারণ অনেক বেশি সম্ভাবনা এই সেক্টরে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এই সেক্টরে কমপিট করতে হয় না বলে প্রান্তিক নারীদের জন্য এটা সুখবর। তবে ব্যবসা পরিচালনা করতে বেসিক কিছু লজিস্টিকস সাপোর্ট দরকার হয় যেটা দেশের সরকার চাইলেই সেটেল করা সম্ভব। মোদ্দাকথা হলো এই বিশ্বায়নের যুগে নারীর জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি চাই করে করে গলা ফাটানোর দিন শেষ হলো বলা যায়। নারী যদি এসময়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হয় তবে সেটা তার নিজের ব্যর্থতা।
‘এক কাপ চা বানাই স্বামীর জন্য’ ভাইরাল একটা ভিডিও। অনেকেই শুনে থাকবেন যেহেতু ভাইরাল ভিডিও নিয়ে প্রচুর ট্রোল করা হয়। প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসকারী এই নারী একজন টিকটকার কিংবা ফেসবুক কনটেন্ট ক্রিয়েটর। তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা সে নিজেই ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তার প্রতিটা ভিডিওতে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ। তার সম্পদ একটা মোবাইল, সেই মোবাইলে কয়েক জিবি ইন্টারনেট এবং ভান্ডারে যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো আউলাবাউলা কন্টেন্ট। যত ভিউ তত উপার্জন!
অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন কঠিন কিছু না। নারীর জন্য কঠিন জায়গা হলো তার প্রতি পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এমন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বহু ফ্যাক্টর দায়ী তবে কিছু ফ্যাক্টর এমনই কঠিন যে সেখানে হাত দেওয়া যায় না। যেহেতু হাত দেওয়া যায় না তাই নারী বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস, অবমাননার ইতিহাস, নিগৃহের ইতিহাস হাজার বছর ধরে চলমান।
নারী দিবসকে সামনে রেখে নারীর সমঅধিকার নিয়ে যত কথাই বলি না কেন নারীর ঘর যদি সেই অধিকার নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে নারী দিবসের থিম চিবিয়ে খেয়েও সেই অধিকার নিশ্চিত হবে না। তো বাধাটা আসলে কোথায়? সেই বাধা কীভাবে অতিক্রম করা যায় সেখানে ফোকাস করতে হবে।
যতদিন নারীর অধিকার আরেকজন ঠিক করে দেবে, যতদিন নারীর লিঙ্গীয় বৈষম্য নিয়ে মতান্তর থাকবে ততদিন বাধাকে অতিক্রম করা যাবে না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নারীর জন্য ইউনিভার্সাল একটা ধারণা তৈরি হোক। নারীর সুদৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থানই পারে নারীকে মুক্তি দিতে। যদিও বিগত সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা খারাপ।
রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও তখনো তাদের মূল্যায়ন ছিল না, এখনো নেই। সীমিত পরিসরে না, রাজনীতিতে নারীর সার্বিক অংশগ্রহণ দরকার। রাজনীতিতে নারীর জন্য প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণের পথ তৈরি হোক। আর সেই পথ ধরে নারীর প্রতি সব রকমের বিদ্বেষ, সহিংসতা, বঞ্চনা আর অবমাননার পথ রুদ্ধ হোক। নারী দিবসে এটাই প্রত্যাশা। ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’ অবস্থায় বছরের পর বছর পার না করে নারী দিবস এবার একটু সাবালিকা হোক।
ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)