বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩১
ছবি সংগৃহীত
ভাইরাস এবং ভাইরাসজনিত জ্বর এই দুটি বিষয়ের সঙ্গেই আমরা পরিচিত। ২০০০ সালের আগে ভাইরাসজনিত জ্বর বলতে আমরা সাধারণ ঠান্ডা জ্বর, ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জাকে বুঝতাম। ভাইরাস শব্দটি বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয় ২০০০ সাল থেকে। কারণ সে বছর দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
ডেঙ্গু জ্বরের উপস্থিতি জনমনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বইয়ে দেয়। ডেঙ্গু শুরুর ২০ বছর পর কোভিড-১৯-র বৈশ্বিক মহামারি ভাইরাস শব্দটির সাথে আতঙ্কের নতুন মাত্রা যোগ করে। সম্প্রতি দুটি ভাইরাসজনিত জ্বর নতুন করে আমাদের চিন্তা ও আশঙ্কার উদ্রেক ঘটিয়েছে। এই ভাইরাস দুটি হচ্ছে জিকা ও নিপাহ।
জিকা ভাইরাস: সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণার ফলাফলে দেশে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ২০২৩ সালে ১৫২ জন জ্বরের রোগীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ২০২৫ সালে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায় ১৫২ জনের মধ্যে ৫ জনের শরীরে জিকা ভাইরাসের উপস্থিতি। এই ৫ জনই এক কিলোমিটার এলাকার ভেতর বসবাস করে।
এজন্য বিষয়টি জিকা ভাইরাসের গুচ্ছ সংক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জিকা একটি আরএনএ ধরনের ভাইরাস। উগান্ডার জিকা নামের গ্রামের একটা বানরের শরীরে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়। জিকা গ্রামের নামানুসারে ভাইরাসটির নাম জিকা দেওয়া হয়।
ডেঙ্গুর মতোই জিকা ভাইরাসের বাহক হচ্ছে এডিস মশা। আবাসিক এবং বুনো উভয় ধরনের এডিস মশা দ্বারাই জিকার সংক্রমণ ছড়ায়। ভাইরাসবাহী নারী এডিসের কামড়ে জিকা ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশের ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
তবে প্রতি ১০০ জন আক্রান্তের মধ্যে ৮০ জনের শরীরে জিকার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বাকি ২০ জনের দেহে রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ দৃশ্যমান হয়। জিকার সাথে ডেঙ্গুর লক্ষণগত মিল রয়েছে। জিকার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, শরীরে লাল লাল ফুসকুড়ি বা র্যাশ ইত্যাদি।
এসব উপসর্গ মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে। রোগের লক্ষণ দেখা যাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে রোগী সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে যায়। জিকা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর ঘটনা বিরল। জিকা আক্রান্ত রোগী মারা না গেলে এই ভাইরাস নিয়ে এত উদ্বেগ কেন?
গর্ভবতী নারীর দেহে জিকার সংক্রমণ হলে গর্ভস্থ শিশুর মাথার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে ক্ষুদ্র মাথার শিশুর জন্ম হয়। স্বাভাবিকের তুলনায় মাথা ছোট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের আকার ক্ষুদ্র হয়। ফলে এদের স্নায়ুতন্ত্রের ও বুদ্ধির বিকাশ কম হয়, খিঁচুনি দেখা দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোট মাথার শিশুর বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিক হতে পারে।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ জিকার আক্রমণের পরে গুলেন ব্যারি সিনড্রোম Guillain–Barré syndrome বা জিবিএস নামের স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়। জিবিএস রোগীর স্নায়ু অকার্যকর হয়ে যাওয়ার দরুণ ধীরে ধীরে শরীরের মাংসপেশিগুলো অবশ হয়ে যায়।
একসময় রোগী শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। নিবিড় পরিচর্যা সেবা ব্যতীত জিবিএসের রোগীকে বাঁচানো কঠিন। জিকার চিকিৎসা উপসর্গভিত্তিক হয়ে থাকে। তবে রোগীর বিশ্রাম, সুষম খাবার ও পর্যাপ্ত পানীয় এবং তরল খাবার গুরুত্বপূর্ণ।
জিকার কোনো টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে গবেষণা চলছে। মশা ছাড়াও যৌনমিলন, আক্রান্ত মা থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে জিকার সংক্রমণ ঘটতে পারে। জিকার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে এডিস মশা নির্মূল করতে হবে। শুধুমাত্র এডিস মশাকে নির্মূল করা হলে আমরা ডেঙ্গু, জিকা, পীতজ্বর ইত্যাদি কয়েক ধরনের সংক্রামক রোগের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এডিস মশা নির্মূল করা না গেলে যেকোনো সময়ে দেশে জিকার মহামারি দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
নিপাহ: আরেকটি ভাইরাসের নাম নিপাহ। ইতিমধ্যে নিপাহ আক্রান্ত তিনজন মানুষের মৃত্যুতে দেশের মানুষ চমকে উঠেছে। দুই যুগ আগে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। বাদুড়, শুকুর ইত্যাদি প্রাণীর মাধ্যমে মানুষ জিকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশে নিপাহ হচ্ছে একটি বাদুড়বাহিত ভাইরাস রোগ। ভাইরাসবাহী বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাবের মাধ্যমে নিপাহ ছড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশে কাঁচা খেজুরের রস বা বাদুড়ে খাওয়া ফলের রস খেয়ে মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। গাছ থেকে সংগ্রহের সময় বিশেষ করে রাতে বাদুড় খেজুরের রস খেতে আসে। সেখান থেকে রস ভাইরাসবাহী হয়ে যায়। এজন্য নিপাহর প্রকোপ থেকে বাঁচতে হলে কাঁচা খেজুরের রস এবং বাদুড়ে/পাখিতে খাওয়া ফল খাওয়া যাবে না।
পরে মাথা ঘোরা, বমিভাব, বমি, তন্দ্রাচ্ছন্নতা, চেতনার পরিবর্তন দেখা দেয়। এগুলো মস্তিষ্কের প্রদাহের লক্ষণ। এসময় খিঁচুনি দেখা দেয়। জিকা সংক্রমণে মৃত্যুর হার ৪০-৭৫ শতাংশ। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি শতভাগ হতে পারে। জিকা আক্রান্ত রোগী বেঁচে গেলে তার মধ্যে স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বুদ্ধি হ্রাস, খিঁচুনি, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ইত্যাদি হতে পারে।
নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার ৪ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরে কোনো লক্ষণের প্রকাশ নাও হতে পারে।
নিপাহর টিকা এখনো বাজারে আসেনি। তবে গবেষণা অনেকটা এগিয়েছে। জিকা ভাইরাসকে মেরে ফেলার মতো নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ এখনো নেই।
শুধুমাত্র সাবধানতার মাধ্যমে আমরা জিকার মৃত্যু ছোবল থেকে রক্ষা পেতে পারি। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রচুর প্রচার করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের দ্বারা প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে জানাতে হবে খেজুরের কাঁচা রস ও পাখিতে খাওয়া ফল খাওয়া যাবে না।
জিকা ও নিপাহ ভাইরাসের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। এজন্য প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়াকে ব্যবহার করে দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে রোগ ও রোগ চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের লক্ষ্য থাকবে রোগ হওয়া নয়, রোগ হওয়ার পূর্বেই রোগটাকে প্রতিরোধ করা।
ডা. লেলিন চৌধুরী ।। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)