মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।’
এই গানের মধ্য দিয়ে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার নানা আয়োজন। প্রতি বছর রমনা বটমূলে ছায়ানট কেন্দ্রীয়ভাবে বর্ষবরণের আয়োজন করে থাকে। এই উৎসবটি বর্ষবরণ শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়।
বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হলো, ‘শুভ নববর্ষ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বর্ষবরণ শোভাযাত্রার প্রস্তুতি ও বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের নববর্ষের পোশাকে সাজের আয়োজন দেখেই বোঝা যায় বাংলা নববর্ষ জাগ্রত বাঙালির দ্বারে দ্বারে।
নববর্ষের সাথে এদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এক গভীর সম্পর্ক ছিল বহুকাল পূর্ব থেকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈশাখে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন।
ওই সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করত। মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো এ উপলক্ষে। পরবর্তী সময়ে বৈশাখ উপলক্ষে যে মেলার আয়োজন করা হতো, সে মেলাকে 'বৈশাখী মেলা' নামে নামকরণ করা হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলা নববর্ষ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়ে এটি আজ বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্থান পেয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তে বাঙালিরা বসবাস করে সেখানেই বৈশাখী উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি এখন শুধু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ নেই, এখন বৈশাখী উৎসব বাঁক নিয়ে অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়েছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। বাংলা নববর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হালখাতা। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে ‘হালখাতা’-র উদ্ভব। আমাদের দেশের সব শ্রেণির ব্যবসায়ীর অর্থাৎ দেশীয় ধরনে যারা ব্যবসায়ের হিসাব রাখেন, তাদের মধ্যেই এ অনুষ্ঠানটির প্রচলন এখনো বর্তমান। তবে সাম্প্রতিক কালে হালখাতার প্রভাব ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের পরিধি প্রসারিত হওয়ার ফলে বাকির খাতায় স্থিতি অনেকটা কমে গেছে। তাতে আকর্ষণ হারাচ্ছে হালখাতার অনুষ্ঠান।
বৈশাখকে ঘিরে পুরো দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয় বিপুল অর্থ। পূর্বে পয়লা বৈশাখকে বরণ করে নেওয়ার আয়োজন ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। এর ওপর ভিত্তি করেই গ্রামীণ নানান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশ লাভ করত। কিন্তু ব্যস্ত নগর জীবনেও এখন নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার ছোঁয়া লেগেছে।
গ্রামমুখী এই উৎসব এখন হয়ে উঠেছে শহরমুখী। আর শহরের মানুষ নানাভাবে এই উৎসবটি পালন করছে। সে কারণে অর্থনৈতিক পরিধি বেড়েছে বৈশাখী আমেজকে কেন্দ্র করে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। নগর জীবনে উৎসবটির জৌলুশ অনেক বেশি। গোটা রাস্তায় আলপনা এঁকে, বর্ষবরণের শোভাযাত্রা হয়।
শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে বিশালাকার চারুকর্ম পুতুল, হাতি ও ঘোড়া, পাখিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। রমনা বটমূলে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে অনুষ্ঠিত হয় বর্ষবরণ সংগীত। নানান রঙের ফুলে ও মালায় ভরে যায় শহর। বৈশাখ ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানের ফুল ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চাঙা হয়।
বর্ষবরণ উপলক্ষে বাজারে বিভিন্ন ডিজাইনের নতুন পোশাকের সমাহার ঘটে। রাজধানীসহ সারা দেশের বিপণিবিতান, মার্কেট, শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাতে ছেয়ে গেছে বৈশাখী সামগ্রী ও রকমারি পোশাকে। বৈশাখ উপলক্ষে দেওয়া হয় আকর্ষণীয় সব অফার।
বাংলা নববর্ষ বরণ করতে শহরের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় বৈশাখী তাঁতবস্ত্র মেলা। বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের তাঁত শিল্প, জামদানি শিল্প উজ্জীবিত হয়। তাঁতিরা বহু আগে থেকে নিত্য নতুন ডিজাইনের কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া বৈশাখকে সামনে রেখে ছোট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিরও (হোশিয়ারি নামে পরিচিত) কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়।
অর্ডার সরবরাহের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেন কারিগররা। শ্রমিকরা কিছুটা বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। স্ক্রিন প্রিন্ট এবং কাপড়ে ব্লক করার দোকানগুলোর ব্যস্ততাও বেড়ে যায়। ছেলেমেয়েরাও দেশি শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ এবং পাঞ্জাবি-লুঙ্গি, ফতুয়া পরে আনন্দে মেতে ওঠে এদিন।
শুধু তাই নয়, অনেক বিদেশিদের ঢাকার রাস্তায় শাড়ি-লুঙ্গি পরে হাঁটতে দেখা যায়। শুধু তাই নয় মৃৎশিল্পীরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আকর্ষণীয় ডিজাইনে বিভিন্ন ধরনের মাটির গয়না বৈশাখী ডিজাইনে তৈরি করে চড়া দামে বিক্রয় করে। এসব আকর্ষণীয় ডিজাইনে তৈরি গয়না পোশাকের সাথে মিলিয়ে তরুণীরা নতুন উদ্যমে কেনাকাটা করছে।
এ উৎসব ঘিরে পাখা মেলছে নানামুখী বাণিজ্য। মাটির পুতুল, বাঁশের বাঁশি, রঙিন বেলুন, ঢোল, ডুগডুগি, ফিতা, পুঁতির মালা, কাচের চুড়ি, গয়না মেলায় বিক্রি হয়। লোকজ পণ্যের মধ্যে মাটির তৈরি নকশি আঁকা হাঁড়ি, সরা, থালা, গ্লাস, বাঁশ-বেতের তৈরি ঝুড়ি, কুলা, চালুনি, লোহার দা-বঁটি, কাস্তে, কোদাল, খন্তা-খুন্তি, কাঠের আসবাবপত্র, হাতপাখা, ফুলের ঝাড়ু সবই মেলায় পাওয়া যায়। বসে নেই খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীরাও। মেলায় পসরা বসে গুড়ের বাতাসা, চিনির দানাদার, কদমা, কটকটি, হাওয়াই মিঠাই, তিলের খাজা, খইসহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন দ্রব্যের।
বৈশাখী মেলা শুধু কেনাকাটার জন্যই নয়, বরং এটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আনন্দের মিলনমেলা। মেলা উপলক্ষে লোকগান, গীতিনাট্য, লোকনৃত্য, বাউল গান, পুতুল নাচ, কৌতুক ইত্যাদি পরিবেশিত হয়। এই সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গ্রামীণ জীবনকে প্রাণবন্ত করে তোলে এবং নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করার সাথে সাথে কর্মসংস্থান বাড়ায়।
বাংলার এই উৎসবকে ঘিরে অন্য সময়ের চেয়ে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উঠানোর পরিমাণও বাড়ে। বিশেষ করে বৈশাখী ভাতা বাজারকে আরও সমৃদ্ধ করেছে বলে উদ্যোক্তা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশে ফ্যাশনশিল্পে মোট বিক্রির অর্ধেক বিক্রি হয় রোজার ঈদে।
মধ্যবিত্তের বিকাশের সঙ্গে এখন ২৫ ভাগ বিক্রি হয় পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। মাটির থালায় পান্তাভাত, হরেক পদের ভর্তা, ইলিশ ভাজি, পাটশাক, শুটকি ভর্তাসহ নানা পদের ভর্তা নিয়ে ছোট ছোট দোকানিরা দোকান সাজিয়ে তাদের ব্যবসাকে চাঙা করতেই ব্যতিব্যস্ত থাকে।
শহরে প্রচলিত পান্তা-ইলিশের সঙ্গে গ্রামীণ জীবনে নববর্ষ উদযাপনের কোনো মিল আছে বলে মনে হয় না। এটি কেবলই শহুরে জীবনে নতুন সংযোজন। যার ফলে অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে ইলিশের দাম এখন আকাশচুম্বী। অসাধু ব্যবসায়ীরা গড়ে তোলে অবৈধ ইলিশের মজুদ। উৎসবকে ঘিরে এ অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে পর্যটন এলাকার হোটেল-মোটেল-রেস্তরাঁসহ সব ধরনের ব্যবসায়ীরাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সেসব এলাকার হাটবাজারেও বেচাবিক্রি বাড়ছে। এ ক্ষেত্রেও সচল হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সবকিছু মিলিয়ে এখন শহর ও গ্রামের বৈশাখের অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠছে। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে, বৈশাখী অর্থনীতির প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এর পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে।
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!’
কালবৈশাখীর ঝড়ে ধুয়ে মুছে যাক সব জরা, গ্লানি। বৈশাখী আনন্দে জমে উঠুক আমাদের অর্থনীতি।
রুনা সাহা ।। সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)