সোমবার, ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ ভাদ্র ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
বিশ্ব-অর্থনীতিতে নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর কোনোটি আজ আর কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল নয়। তাই ২০২৫ সালে এসে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বন্দনা অনেকের কাছে সেকেলে, বিবর্ণ ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, সব দেশের মুক্তির পথ একই রকম হয় না।
একটি অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হবে নাকি শিল্পভিত্তিক হবে—তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সমাজের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ভৌগোলিক বাস্তবতা, সম্পদের প্রাপ্যতা এবং বৈশ্বিক বাজারের চাহিদার ওপর। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সাধারণত একটি জাতির প্রাথমিক বিকাশে সহায়ক হয়, কারণ এটি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে।
তবে কেবলমাত্র কৃষির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে দক্ষ বা টেকসই হয়ে উঠতে পারে না, কেননা কৃষি উৎপাদন প্রকৃতির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বৈশ্বিক মূল্য ওঠানামা—সবকিছুই কৃষিকে সহজেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়।
অন্যদিকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে অধিক দক্ষ, কারণ এটি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, প্রযুক্তির ব্যবহারকে বিস্তৃত করে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা জোগায়। শিল্পায়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, মানুষের আয় বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে জীবনমান উন্নত করে।
বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প একটি অর্থনীতিকে দ্রুত বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যময় করতে সক্ষম। তবে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়—যা সব দেশের পক্ষে সমানভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়।
সবচেয়ে কার্যকর অর্থনৈতিক কাঠামো সাধারণত সেইটিই, যেখানে কৃষি ও শিল্প উভয় খাতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। কৃষি খাদ্য ও কাঁচামালের জোগান দেয়, আর শিল্প সেই কাঁচামালকে রূপান্তরিত করে উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরি করে। তাই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি একটি জাতির প্রাথমিক বিকাশে অপরিহার্য হলেও, দীর্ঘমেয়াদে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিই অধিক কার্যকর ও টেকসই প্রমাণিত হয়।
বস্তুনিষ্ঠভাবে কৃষি বা শিল্প অর্থনীতির দক্ষতা বুঝতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে TFP সূচকে। TFP বা Total Factor Productivity অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি, যা কেবল শ্রম, জমি, সার, পানি বা যন্ত্রপাতির পরিমাণ বৃদ্ধিকে নয় বরং এগুলোর কার্যকর ব্যবহার ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন কতটা বাড়ছে—তা নির্দেশ করে।
সহজভাবে বলতে গেলে, একজন কৃষক যদি একই পরিমাণ জমি, পানি ও সার ব্যবহার করেও আগের চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন করতে পারেন, তবে সেই বাড়তি উৎপাদন এসেছে তার দক্ষতা, উন্নত প্রযুক্তি বা নতুন কৌশল প্রয়োগের কারণে। একে বলা হয় মোট উপাদান উৎপাদনশীলতা (Total Factor Productivity-TFP) বৃদ্ধি।
TFP সাধারণত বৃদ্ধি পায় যখন—উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণা ব্যবহার হয় (যেমন হাইব্রিড বীজ, ড্রিপ সেচ, স্মার্ট ফার্মিং); জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ে (যেমন কৃষক প্রশিক্ষণ, আধুনিক ব্যবস্থাপনা) এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নীতি উন্নত হয় (যেমন বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার, সরকারি সহায়তা)।
১৯৯১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ব্রাজিল, চীন, মেক্সিকো ও ইউক্রেন—এই দেশগুলোতে TFP বছরে গড়ে ২শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তাদের অর্থনীতিকে দ্রুত ও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে মোট উপাদান উৎপাদনশীলতা (TFP) দীর্ঘমেয়াদে খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৪৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত গড়ে বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল মাত্র ০.৫৭ শতাংশ যা মূলত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফল, যদিও প্রযুক্তিগত দক্ষতার উন্নতি কার্যত হয়নি। পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ১৯৮৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে এই প্রবৃদ্ধি আরও কমে বছরে মাত্র ০.০৩ শতাংশে নেমে আসে, যেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বরং সামান্য হ্রাস পেয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেলেও চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়—২০০১–২০১০ সময়কালে যেখানে বার্ষিক TFP প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২.৪ শতাংশ, ২০১১–২০১৬ সময়ে তা কমে গিয়ে প্রায় ১ শতাংশে নেমে আসে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের কৃষিতে উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন এখনো মূলত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির হার ধীর এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
এর মূল কারণ শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়; দক্ষতাও একটি বড় নির্ধারক, যা বাংলাদেশের কৃষিতে এখনো অনুপস্থিত। দক্ষতা-ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো কৃষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। একজন কৃষক মাটির অবস্থা অনুযায়ী সঠিক ফসল নির্বাচন, সার ও সেচের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ, রোগবালাই বা কীটপতঙ্গ দমন—সবই তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে।
দক্ষ কৃষক প্রযুক্তি কম ব্যবহার করেও ফলন সর্বাধিক করতে সক্ষম, কারণ তিনি কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিল, চীন ও ভারতের অনেক অঞ্চলে কৃষকরা সীমিত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ফলন অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে কৃষকদের দক্ষতা বাড়ানোর নানা প্রচেষ্টা চলমান। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তা কতটা কার্যকর হচ্ছে? প্রায়ই কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির অভাবকে দায়ী করা হলেও, বাস্তবে দেখা যায় প্রযুক্তির ভুল ব্যবহারের কারণে বড় ক্ষতি হচ্ছে। সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ হলো, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার। যেমন বেগুন চাষে অনেক ক্ষেত্রে ১৫০ বার পর্যন্ত কীটনাশক স্প্রে করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের চেয়ে বহু গুণ বেশি। এর ফলে কৃষকদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা এমনকি দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বেড়েছে।
শুধু কীটনাশক নয়, ট্রাক্টর, কম্বাইন হারভেস্টার, রোটাভেটর, সিড ড্রিল ইত্যাদি যন্ত্রপাতির অদক্ষ ব্যবহারও বড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে কার্যকর, কিন্তু এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অনেক বেশি। যেমন, একটি কম্বাইন হারভেস্টারের দাম ২৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, আর এর রক্ষণাবেক্ষণে বছরে প্রায় ২ লক্ষ টাকা খরচ লাগে।
দক্ষভাবে ব্যবহার না করলে ধানের একটি বড় অংশ নষ্ট হয় এবং উৎপাদন কমে যায়। ট্রাক্টর বা রোটাভেটরের ভুল ব্যবহারে মেরামতের খরচ বাড়ে, কৃষকের আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পায়, পাশাপাশি মাটির উর্বরতা হ্রাস, জল অপচয় এবং সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করে।
তাই, আধুনিক যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য। এটি একদিকে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, খরচ কমায়, অন্যদিকে কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা কিছুটা কঠিন। এখানে নেই শিল্পবিপ্লব ঘটানোর মতো বিপুল সম্ভাবনা, নেই অতি প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সক্ষমতা ও সুযোগ। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো কৃষিজমির স্বল্পতা। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাজিলে কৃষিজমি প্রায় ১৪৩.৯ মিলিয়ন হেক্টর, ভারতে ১৫৬.৮ মিলিয়ন হেক্টর এবং চীনে ২৬৯ মিলিয়ন হেক্টর; অথচ বাংলাদেশে তা মাত্র ৮.৫ মিলিয়ন হেক্টর। সংখ্যাটি এতটাই কম যে মাথাপিছু হিসাবের কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থ দাঁড়ায় না।
সাধারণত মধ্যসত্ত্বভোগীরা কৃষকের কাছ থেকে ফসল বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে কিনে নেন, ফলে কৃষক নিজের খরচও পূর্ণভাবে তুলতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ, ধান বা সবজি বিক্রির ক্ষেত্রে কৃষক উৎপাদিত মূল্যের মাত্র ৫০–৬০ শতাংশ পান, আর বাকি অংশ চলে যায় মধ্যসত্ত্বভোগীর পকেটে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো—যতগুলো দেশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশই সর্বাধিক অংশের জমি (প্রায় ৫৯ শতাংশ ভূখণ্ড) কৃষিকাজে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ, সীমিত কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশের জন্য টেকসই কৃষি বিপ্লব অর্জন করা সহজ নয়। ফলে ভবিষ্যতে আমাদের কৃষি খাতকে কেবল প্রযুক্তি নির্ভরতা নয়, বরং দক্ষতা বৃদ্ধি, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষিতে মুক্তি আসা কঠিন হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হলো কৃষি বাজারে মধ্যসত্ত্বভোগীর (middlemen) প্রভাব। এরা কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করলেও, বাস্তবে অনেক সময় কৃষকের ন্যায্য লাভ নিশ্চিত করার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
মধ্যসত্ত্বভোগীর প্রভাব এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো, কৃষি বাংলাদেশের বিশাল অংশের মানুষের পেশা। এমন একটি সম্পদহীন দেশে মানুষ যেকোনো খাতে নিজেদের জীবিকার তাগিদে যুক্ত হওয়া স্বাভাবিক। তাই বাংলাদেশের বাস্তবতা অনন্য। চীনের বা ব্রাজিলের মডেল সরাসরি প্রয়োগ করে অথবা টেকসই উন্নয়নের কোনো ম্যানুয়াল অনুসরণ করে আমাদের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন বাংলাদেশের নিজস্ব দক্ষতা। অর্থাৎ প্রযুক্তি-নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার চেয়ে দক্ষতা-ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার দিকে মনোনিবেশ করাই অধিক কার্যকর।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ডিএস /সীমা
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)