শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বর্তমানে আরও আশাবাদী অবস্থায় এসে সুন্দর, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন হবে সেটা যখন লিখতে যাচ্ছি, তখন মনে হলো—আচ্ছা সবচেয়ে ভালো মানের সড়ক, সবচেয়ে নিরাপদ গাড়ি, ডিজিটাল সব ব্যবস্থা থাকলেও কি আমরা বলতে পারি যে আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা ভালো বা নিরাপদ? উত্তর হচ্ছে—না।
কারণ, সব ভালো ব্যবস্থা দিনশেষে কাজ করবে না যদি দুটি বিষয় আমরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হই, তার একটি হলো সড়ক ব্যবহারকারীদের শৃঙ্খলা, আর অন্যটি হলো বিশৃঙ্খলা করেও পার পেয়ে যাওয়া। আজ পর্যন্ত শৃঙ্খলা, যানজট, সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে হাজারও সুপারিশ, পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে, তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে আমরা পারছি না কেন? এটা কি কোনো রকেট সাইন্স?
এটা কোনো রকেট সাইন্স না। আমরা পারছি না কারণ, টাকা খরচ করে ভালো রাস্তা তৈরি করা যায়, টাকা খরচ করে দামি গাড়ি রাতারাতি কিনে ফেলা যায় কিন্তু টাকা খরচ করেই এই রাস্তা যিনি ব্যবহার করছেন, এই গাড়ি যিনি চালাচ্ছেন তার আচরণ পরিবর্তন করা যায় না। আচরণ পরিবর্তন দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
এক, সড়কে কী করতে হবে, কী করা যাবে না, কেন করা যাবে না, করলে ক্ষতি কী আর না করলে লাভ কী—এসব বিষয়ে জানা। আর দুই নাম্বার হলো, সড়কে গিয়ে সেই জানা বিষয়গুলো ব্যবহারের সুযোগ প্রাপ্তি। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক।
ধরুন, আমরা আমাদের বাচ্চাদের জেব্রাক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হতে হয় এটা শেখালাম। এখন এই শিক্ষা সে অল্প কিছুদিন পরেই ভুলে যাবে দুটি কারণে। এক, যদি সে রাস্তায় গিয়ে জেব্রাক্রসিং বা ফুটওভার ব্রিজ না দেখে আর দুই, যদি এসব থাকার পরেও কোনো বাঁধা ছাড়াই অন্যদের রাস্তা পার হতে দেখে। তাহলে আমাদের একদিকে জানাতে হবে তেমনি অন্যদিকে প্রয়োগের ব্যবস্থা করে বাধ্য করতে হবে।
সড়কের শৃঙ্খলার জন্য দুই ধরনের ব্যবহারকারীদের গুরুত্ব দিতে হবে। এক, পথচারী আর দুই, হলো চালক। যাত্রীর কথা বলছি না কারণ যানবাহনের ওঠার আগ পর্যন্ত সে কিন্তু পথচারী থাকে। পথচারীরা মূলত দুইভাবে সড়ক ব্যবহার করে যেমন সড়কের বরাবর হাঁটা এবং সড়ক পারাপার হওয়া। অন্যদিকে পথচারীরা আবার দুইভাবে সড়কের আচরণ ভঙ্গ করে, একটা হলো ইচ্ছাকৃত আরেকটা অনিচ্ছাকৃত।
বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক। একজন পথচারী যখন রাস্তা বরাবর হাঁটে তখন তার জন্য প্রয়োজন ফুটপাত। এখন এই ফুটপাত তিনি দুটি কারণে ব্যবহার করতে পারেন না, এক হলো ফুটপাতে হকার, দোকানের মালামাল ইত্যাদি থাকা আর দ্বিতীয়টি হলো, ফুটপাতের কন্টিনিউশন না থাকা। কিছুক্ষণ পর পর ফুটপাত কাটা বা ড্রপ থাকলে পথচারীকে বারবার ওঠা-নামা করতে হয় যা মহিলা, শিশু, বয়স্ক, মাথায় বা হাতে বোঝা নিয়ে চলমান পথচারীদের জন্য সমস্যা। এর ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একজন সচেতন নাগরিককে ফুটপাত বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে হয় হাঁটার জন্য।
আবার অন্যদিকে রাস্তা পারাপার হওয়ার সময়ও জেব্রা ক্রসিং একটু দূরে থাকলে বা ফুট ওভারব্রিজে উঠতে কষ্ট হয় বা পারাপারে বেশি সময় লাগবে ভেবে মানুষ যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হয়। এভাবে ইচ্ছাকৃতভাবেও আমরা সড়কে ঝুঁকি নেই আর যেহেতু এই কাজে কেউ আমাদের বাঁধা দিচ্ছে না সেহেতু একসময় এটাই অভ্যাসে পরিণত হয়।
চালকদের আচরণ দুইভাবে সড়কের শৃঙ্খলার সাথে জড়িত। এক গাড়ি চালানো অবস্থায় আচরণ আর দুই হলো গাড়ি থামানো বা পার্কিং। গাড়ি চালনোর সময় যেসব বিশৃঙ্খলা চালক করে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, লেন মেনে না চলা, বিপদজনক ওভারটেকিং, বেপরোয়াভাবে চালানো, ইন্ডিকেটর না থাকা বা থাকলেও তার ব্যবহার না করা ইত্যাদি।
আর পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে চালকরা যত্রতত্র পার্কিং করতে চায়, বাস স্টপেজ ব্যবহার না করা, অন্য সড়ক বা যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা করে গাড়ি থামানো ইত্যাদি। আসলে এ ধরনের অনেক সমস্যা বলে শেষ করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে এগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি?
লেখার শুরুতে দুটি সমাধানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রথমত সড়ক ব্যবহারকারীদের জানাতে হবে আর দ্বিতীয়ত আইনের দ্বারা বাধ্যতামূলক মানাতে হবে। জানানোর জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা খুব জরুরি—
১। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক আইন ও সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য ১ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা।
২। সড়ক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য বিভিন্ন আয়োজনে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট করে এ বিষয়গুলো হাতে-কলমে শেখানো। এক্ষেত্রে ট্রাফিক প্লে গ্রাউন্ড (Traffic Play Ground) তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে কৌশল শেখানো।
৩। ড্রাইভিং স্কুলের প্রশিক্ষণের মানদণ্ড নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাস প্রস্তুত করা এবং একটি সহজ ভাষায় ড্রাইভার ম্যানুয়াল (Drivers Manual) তৈরি করা। প্রতিটি ড্রাইভিং স্কুলকে উক্ত সিলেবাস ও ম্যানুয়ালের আলোকে মোটরযান চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান নিশ্চিত করা।
৪। বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্সের পরীক্ষা আধুনিকায়ন করা এবং ড্রাইভিং স্কুলের সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা। এজন্য বিআরটিএ-এর সক্ষমতা যেমন বাড়াতে হবে তেমনি ভালো মানের ড্রাইভিং স্কুল তৈরিতে উৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের কাজ মনিটরিং করতে হবে।
৫। অযান্ত্রিক বাহনের (রিকশা, সাইকেল, ভ্যান) চালকের জন্য সহজবোধ্য নির্দেশিকা তৈরি করে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। বাধ্যতামূলকভাবে পেশাদার চালকদের জন্য On Job Training-এর আদলে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা। এক্ষেত্রে প্রত্যেক টার্মিনালে চালকের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
৬। গবেষণায় পরীক্ষিত যে, নারী মোটরযান চালক অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি নেয় ও নিরাপদে মোটরযান চালনা করে। তাই নারীদের এ পেশায় আসার বিষয়ে উৎসাহিত করতে আলাদা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা উচিত। সরকারি, বেসরকারি চাকরিতে নারী মোটরযান চালকদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
৭। সড়কে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যাত্রী উঠানামার জন্য বাসস্টপেজ বা বাস-বে, যাত্রী ছাউনি, লেফট লেন ইত্যাদি স্থাপন করা এবং বাসস্টপেজ পরিষ্কার ও দখলমুক্ত রাখা। সাইন-মার্কিং বসানো এবং সেগুলো কী অর্থ বহন করে তা চালকদের বোঝানো। শ্রম আইন অনুসারে চালকদের বেতন কাঠামও নিশ্চিত করে, বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেম এ গণপরিবহন পরিচালনা করে চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বন্ধ করা সম্ভব।
৮। পথচারীদের জন্য কিছু ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। পথচারীদের রাস্তার সমতলে পারাপারের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে এবং নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের চলাচলের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে পারাপারের ব্যবস্থা করতে হবে। সমীক্ষার মাধ্যমে বড় সংযোগস্থল যেখানে পথচারী পারাপার বেশি সেখানে পথচারীদের জন্য স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং সিস্টেম বা All Red System প্রবর্তন করা।
৯। জেব্রাক্রসিং, ফুটপাত, ফুটওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস সুন্দর, পরিষ্কার ও নিরাপদ রাখা। ফুটওভারব্রিজ প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা। ফুটওভার ব্রিজ, স্কাইওয়াক বা আন্ডারপাস নির্মাণে বিজ্ঞানভিত্তিক সার্ভে করে উপযোগিতা, স্থান ও পরিবেশবান্ধব নকশা প্রণয়ন করা।
১০। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ধর্মীয় উপাসনালয়ের সামনে উঁচু করে পথচারী পারাপারের জন্য (Raised Pedestrian Crossing) চিহ্ন দিয়ে তার পূর্বে এক সেট Rumble Strip দেওয়া। এক্ষেত্রে মার্কিং সবসময় ঠিক রাখতে হবে। রাস্তার ফুটপাতের উচ্চতা রাস্তা থেকে অন্তত ৮ (আট) ইঞ্চি এবং দুই প্রান্তকে ন্যূনতম ঢাল (v/h) ১:১৫ (1:15) থেকে ১:২০ (1:20) করা।
১১। কোনোভাবেই ফুটপাতে হকার বাসানো যাবে না বা পর্যাপ্ত স্পেস থাকলে এবং রাস্তা একইসমতলে মেলানো যাবে না। রাস্তার ডিভাইডার বরাবর পথচারীদের জন্য প্রতিবন্ধক ফ্রেম (Barrier) স্থাপন করা যাতে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার বন্ধ হয়। কোনো কারণে এই প্রতিবন্ধক ফ্রেম (Barrier) নষ্ট হলে দ্রুত ঠিক করা। ইত্যাদি অনেক কিছুই করা সম্ভব এবং ইতিমধ্যে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের মাধ্যমে এ সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো সুপারিশ করা হয়েছে।
১১। সড়ক ব্যবহারকারীদের জানানোর পর মূল কাজ হলো কেউ যদি তা অমান্য করে তার বিরুদ্ধে আইন মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুটি জিনিস জরুরি। এক হচ্ছে স্বচ্ছতা আর দুই হচ্ছে বৈষম্যবিহীন আইনের প্রয়োগ। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার জন্য ট্রাফিক পুলিশের বডি ক্যামেরা ব্যবহার করা যেতে পারে যা পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে।
১২। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেন কোনো বৈষম্য না থাকে এবং প্রয়োগ যেন সবার জন্য সমান হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষ যদি দেখে যে, নির্দিষ্ট কোনো স্টিকার, কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য, প্রভাবশালী কেউ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে চলে যাচ্ছে তখন আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে এবং তাদের প্রযুক্তি নির্ভর করতে হবে।
১৩। সিসি টিভি, মনিটরিং ক্যামেরা, স্পিড ক্যামেরা স্থাপন করে এমন ব্যবস্থাপনা করতে হবে যেন সড়কে আইন অমান্য করে পালিয়ে যাওয়া যাবে কিন্তু পার পাওয়া যাবে না সেটা সকলের বোধগম্য হয়।
১৪। সর্বোপরি, যেকোনো চাঁদাবাজি এবং সড়কের পাশে অবৈধ দখল বন্ধ করতে হবে আর এ জন্য অতি দ্রুত রাজনৈতিক অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)