শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সারাদেশে শিক্ষক লাঞ্ছনা চলছে। সেইসব খবর আমরা দেখছি। শিক্ষার্থীদের, শিক্ষকদের বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের ওপর ক্ষোভ বেশি। এইসব দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। দেখতে ভালো লাগে না। কেন এমন হলো বা হচ্ছে?
বাংলাদেশে শিক্ষকরা বা শিক্ষার্থীরা কেউ কখনো ভালো ছিল না। বিশেষ করে স্কুল লেভেলের শিক্ষকরা তো নই। শিক্ষকদের বেতনে ভুগিয়েছে, সম্মানে ভুগিয়েছে, রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে ভুগিয়েছে, পেনশন আনতে গিয়ে ভুগতে হয়েছে তাদের।
সমাজের কাছে হেয় করার জন্য এমন মানুষদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে যারা কখনো কল্পনাও করেনি তারা শিক্ষক হবে। দলের ক্যাডার বা দলান্ধদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের দিয়ে প্রকৃত শিক্ষকদের নির্যাতন করিয়েছে।
বাংলাদেশের স্কুল ও কলেজের এমন এমন মানুষকে প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ বানিয়েছে যারা শিক্ষকতার চেয়ে রাজনীতি আর দুর্নীতি বেশি করেছে। শিক্ষার্থী ভর্তিতে দুর্নীতি, পরীক্ষার খাতায় নম্বর দিতে দুর্নীতি ছাড়াও অনেক কিছুতেই অনৈতিক কাজে জড়িত ছিল। আরেক শ্রেণির শিক্ষক স্কুল বা কলেজে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট বা কোচিং-এ পড়িয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা স্কুল বা কলেজে সত্যিকারের শিক্ষক পায়নি। সম্মান তো আর দান করার বিষয় না যে শিক্ষক হয়েছে বলেই শিক্ষককে সম্মান করতেই হবে। সম্মানটা তো অর্জন করতে হয়।
সব জায়গায় এমন হয়েছে বা হচ্ছে তা আমি বলছি না। এমন অনেক শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষার্থী অন্তপ্রাণ। আমরা মুন্সীগঞ্জের হৃদয় মন্ডলের কথা জানি। নওগাঁয় মহাদেবপুরের আমোদিনী পালের কথা জানি। এইরকম অসংখ্য শিক্ষকদের উদাহরণ দেওয়া যাবে। যেমন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চখমিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাতিয়ার বানিয়ে তাদের ভুল বুঝিয়ে ২৫ আগস্ট দুপুরে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সেলিম উদ্দীন, সহকারী শিক্ষক মো. ইয়াছিন আলী, মো. নুরে আলম এবং শরণ শিং’কে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ।
পরবর্তীতে ফুলের মালা দিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পা ধরে ক্ষমা চায়। এতে কান্নার রোল পড়ে যায় সেই বিদ্যালয় মাঠে। শিক্ষার্থীরা জানায়, রাজনৈতিক কিছু নেতা তাদের ভুল বুঝিয়ে এই কাজ করিয়েছে। এটা একটা দৃষ্টান্তই বটে।
অপরদিকে বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শুক্লা রানীকে পদত্যাগে বাধ্য করায় নিন্দার ঝড় ওঠে। অবরুদ্ধ অবস্থায় শুক্লা রানীর হালদারের অসহায় অবস্থার ছবি দিয়ে ঘটনার প্রতিবাদে নেমেছেন তার প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন। আমি আশা করছি, শিক্ষার্থীরা এই বিষয়েও তাদের ভুল বুঝতে পারবে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৯ শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জনকে সপদে বহাল করা সম্ভব হয়েছে। কেউ অন্যায় করে থাকলে প্রশাসন বিচার করবে। শিক্ষার্থীরা যেন এমন কাজ না করে এটা আমার অনুরোধ।
আমাদের সরকার শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে এমন অনাকর্ষণীয় করে ফেলেছে যে ক্যারিয়ার হিসেবে শিক্ষকতা পেশাকে কেউ বেছে নেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয় না। স্বপ্নহীন মানুষ আসলে পশুর মতো। কেউ মানুক আর নাই মানুক শিক্ষকতা ভিন্নরকম পেশা। এই পেশায় নীতি নৈতিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পেশায় যারা আসবেন তাদের আদর্শ মানুষ হওয়ার তীব্র বাসনা থাকতে হয়। মিলিয়নিয়ার বা বিলিওনিয়ার হওয়ার জন্য কেউ কোনো দেশে শিক্ষকতা পেশায় আসে না।
তার মানে এই না যে তাদের তীব্র অর্থ কষ্ট নিয়ে জীবনযাপন করতে হবে। তারা সংসার চালাতে পারবে না। ছেঁড়া জামা পরে, খেয়ে না খেয়েও একখানা হাসি মুখে শিক্ষার্থীদের ভালোবেসে যাবে, হাসিমুখে পড়াবে। ১০০ বছর আগে এইরকম চিত্রই ছিল। পৃথিবী এখন বদলে গেছে। আজকের পুঁজিবাদী সমাজে এই চিন্তা অসার।
সমাজের অন্যসব পেশার বেতনও কম। কিন্তু অন্যসব পেশায় দুর্নীতির সুযোগ আছে। এই যে শিক্ষার্থীরা বিসিএস পুলিশ, ট্যাক্স, প্রশাসন ইত্যাদিতে চাকরি পেতে মরিয়া সেটা কি বেতনের জন্য? না। দুর্নীতির অবারিত সুযোগ সাথে বোনাস হিসেবে আছে ক্ষমতা।
ক্ষমতা মানে কী? ক্ষমতা মাপা হয় কে, কী প্রক্রিয়ায় অন্যদের দুর্ভোগে ফেলতে পারে। সমস্যা হলো, এই দুর্নীতি যখন শিক্ষকতা পেশাতেও ঢুকে যায় তখন দেশ আর দেশ থাকে না। শিক্ষক যখন ক্লাসে ইচ্ছে করে কম পড়িয়ে, খারাপ পড়িয়ে, পরীক্ষায় নম্বর কম দিয়ে নিজের প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টারে পড়তে বাধ্য করে তার যে সুদূর প্রসারী ক্ষতি সেটা আমাদের নীতিনির্ধারকরা কখনো চিন্তা করে দেখেনি।
শিক্ষার্থীরা তো বোকা না। তারা তাদের শিক্ষকদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি করতে দেখেছে। ক্লাসে সরকারি দলের স্লোগান দিয়েছে। এলাকার সরকারি দলের এমপি চেয়ারম্যানের কাছে ধরনা দিয়েছে। এইসব কোনোকিছুই কি শিক্ষকতা পেশার সাথে যায়? আজকে শিক্ষার্থীরা সেইসব পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ঢালছে। আমরা বড়রা কি এটা নিয়ে আগে কথা বলেছি?
বিশ্ববিদ্যালয়েও আমার চারপাশে এমন শিক্ষক দেখি যাদের তো শুধু বিশ্ববিদ্যালয় না স্কুল কলেজের শিক্ষকও হওয়ার কথা না। এদের হওয়া উচিত ছিল ব্যবসায়ী বা অন্য কিছু হওয়া। ঘটনাচক্রে শিক্ষক হয়ে শিক্ষক শিক্ষক অভিনয় করছে কিন্তু সেই অভিনয়টুকুও ঠিকভাবে পারে না। তাদের আপনি কীভাবে সম্মান করতে বলবেন?
তাই সময় এসেছে শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর। শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করার। শুধু এই কাজটা করতে পারলেই সমাজের অন্যসব অসংগতি বা সমস্যা দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।
শিক্ষার্থীরা যখন সত্যিকারের মডেল শিক্ষক পাবে তারা শিখবে কীভাবে আচরণ করতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে রাস্তায় চলতে হয়, কোথায় ময়লা ফেলতে হয়, ট্রেনে বা বাসে কাদের দেখলে সিট ছেড়ে দিতে হয়, শিক্ষকদের কীভাবে সম্মান দিতে হয়, কীভাবে অন্য ধর্মের মানুষদের সম্মান দিতে হয়, কীভাবে তাদের উপাসনালয় আক্রান্ত হলে প্রতিবাদ করতে হয়, কীভাবে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।
বাংলাদেশের সব সমস্যার মূল হলো শিক্ষা। এই সংকট নিরসনে আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আশা করছি, সব সংকট সামলে শিক্ষকতা পেশা আরও সম্মানজনক ও আকর্ষণীয় হবে।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)