বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১
১৯৬৯ সাল। পূর্ব পাকিস্তান মিউজিক কম্পিটিশন হলো দেশ জুড়ে। ছোটদের গ্রুপে আমি আধুনিক গানে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক এবং পল্লীগীতিতে দ্বিতীয় হয়ে রৌপ্য পদক পেলাম। বিভিন্ন পত্রিকায় আমার ছবিসহ প্রতিবেদন ছাপা হলো।
একদিন রেডিও পাকিস্তান, শাহবাগ ঢাকা কেন্দ্র থেকে কিংবদন্তি বংশীবাদক, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ধীর আলী মিঞা আমাদের কলাবাগান লেক সার্কাসের বাসায় এসে বললেন, তাকে রেডিও পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পাঠিয়েছেন। আমরা যারা উপরোল্লিখিত কম্পিটিশনে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় হয়েছি, তাদের অফিসে যেতে হবে। ওখানে একটি অনুষ্ঠান হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছু শিল্পী, কর্মকর্তারা আসবেন সেই অনুষ্ঠান দেখতে।
পরদিন আমি রেডিও অফিসে গেলাম। ৬নং স্টুডিওতে রিহার্সাল এবং সেদিন সন্ধ্যায় ওখানেই অনুষ্ঠান হবে। রিহার্সাল শেষ করে আমার বের হওয়ার মুহূর্তে একজন তার পাশেরজনকে বললেন—‘এরাই আগামী দিনের গানের ভবিষ্যৎ।’
কথাটা এখনো কানে বাজে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি যিনি আমার গানে গিটার বাজিয়েছিলেন, মুখে দাড়ি, কিন্তু সুন্দর চেহারার স্মার্ট এক যুবক। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সংগীতাঙ্গনের তথা দেশের গর্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক, সদ্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় সুজেয় শ্যাম দাদা। তখন তার সাথে সামান্য কথা হয়েছিল। জেনেছিলাম, তিনি যন্ত্রশিল্পী হয়ে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় এসেছেন।
তখন থেকেই রেডিওতে ছোটদের আসরে নিয়মিত অনুষ্ঠান শুরু করলাম। শিমুল বিল্লাহ (ইউসুফ), শেলু বড়ুয়া, আবিদা সুলতানা, পিয়ারু, নাশিদ কামাল, মিলি, বিনু আরও অনেকে। তখন শ্যামদা’র সুরে অনেক গান করেছি। আগের দিন রিহার্সাল করে পরদিন সরাসরি রেডিওতে গাইতে হতো।
এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার ৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দেখা হলো শ্যামদা’র সাথে। ওখানে তো সবার থাকার জায়গা হয়নি। উনি ছিলেন। দেখা হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে এবং আরও যারা ছিলেন—তাদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় সমর দাস, অজিত রায়, মো. আব্দুল জব্বার, রথীন্দ্রনাথ রায়, আপেল মাহমুদ, কাদেরী কিবরিয়া, অরূপ রতন চৌধুরী, মান্না হক, সরকার ফিরোজ উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন।
আমার সাথে আগে থেকে সখ্যতা ছিল, পারিবারিক সম্পর্ক ছিল অজিতদা’র। তিনি আমাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন। আমার দুই দিদিকে রবীন্দ্রসংগীত শেখাতেন। আর সাংবাদিক ও গীতিকার আবিদুর রহমান ভাইয়ের ধানমন্ডি ৫নং রোডের পূর্ব দিকে গ্রিন রোড সংলগ্ন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান কালচারাল একাডেমিতে কাদেরী কিবরিয়া এবং অরূপ রতন চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ হতো এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা গান গাইতাম।
লাকী আকন্দ ভাইয়ের সাথেও বহুবার পূর্ব পাকিস্তান আমলে একসাথে অনুষ্ঠান করেছি। তাই লাকী ভাইয়ের সাথে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বেশ হৃদ্যতা ছিল বরাবর। আমি প্রথমে কলকাতার নারকেলডাঙা থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করতাম। পরে কলকাতার বাইরে ২৪ পরগণার নিউ ব্যারাকপুর থেকে বালিগঞ্জ যেতাম।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনেক গান রচিত হয়েছে সেই সময়। হঠাৎ লেখা এবং সুর করা। আবার বিভিন্ন পরিস্থিতির প্রয়োজনে লেখা ও সুর করা গানও রচিত হয়েছে। সেই সময়ে সুর করা সুজেয় শ্যামদা’র কিছু গান এখনো মানুষের মুখে ফেরে। ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’—এটি অন্যতম। এই গানের গীতিকার আবুল কাশেম সন্দীপ।
সুজেয় শ্যামের সুর করা গান অসংখ্য। এর মধ্যে ‘আয়রে চাষী মজুর কুলি’, গীতিকার কবি দেলওয়ার; বিশ্বপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের কথায় ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’, ‘ওরে শোন রে তোরা শোন’ এবং ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি পুণ্য সলিলে’ অন্যতম।
আনোয়ার কবির-এর কথায় ‘হাজার ভাইয়ের বিয়োগ ব্যথা’; সুব্রত সেনগুপ্ত-এর কথায় ‘রক্ত চাই অত্যাচারীর রক্ত চাই’; শহীদুল ইসলাম-এর কথায় ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ এবং ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’।
‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ গানটি বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক এবং নতুন প্রজন্মের জন্য একটি উপযুক্ত গান। ‘আহা ধন্য আমার জন্মভূমি পুণ্য সলিলে’ গানটি শুনলে সুরের আবেগে চোখ ভিজে যায়! ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’ গানটিতে প্রচণ্ড উন্মাদনা জাগে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শ্যামদা’র সর্বশেষ গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’। আবার এই গানটি নতুন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল বেলা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ফ্লোরে বসে একটি গানের রিহার্সাল চলছে। দুপর আড়াইটার দিকে খবর এলো ঢাকা সারেন্ডার করেছে। দেশ স্বাধীন! এবার নতুন গান, স্বাধীনতার গান লাগবে।
শহীদুল ইসলাম ভাই একটু একটু করে লিখলেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’। সুজেয় শ্যাম’দা ওখানে বসে সুর করছেন, আমাদের তুলে দিচ্ছেন। ১৫ মিনিট থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে গান তৈরির কাজ শেষ। এবার রেকর্ডিং করতে হবে।
শ্যাম’দা অজিতদা’কে বললেন, দাদা, আপনাকে লিড দিতে হবে। পরে আমরা সবাই মিলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গানটি রেকর্ড করি!
শ্যাম’দার সুরে প্রচুর আধুনিক গান আছে। যারা তার সুর করা আধুনিক গান নিয়ে গবেষণা করেছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন, গান তুলেছেন এবং রেকর্ড করেছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন যে, শাস্ত্রীয় সংগীতে তার মেধা কত বিস্তৃত ছিল!
কী অসম্ভব সুন্দর সুর এবং অর্কেস্ট্রেশন! শ্যামদা’র সুরে ’৯০ এর দশকে বাংলাদেশ বেতারে আমি বেশকিছু গান করেছি। তার মধ্যে একটি দেশের গান করেছি আবদুল হাই-আল-হাদী ভাইয়ের কথায় ‘সোনার মুকুট পরিয়ে, পক্ষীরাজে চড়িয়ে।’
দিনে দিনে এমন সব সংগীত নক্ষত্রদের হারিয়ে সংগীতাঙ্গন শূন্য হয়ে যাচ্ছে! একে একে অনেকেই চলে গেছেন। শ্যাম’দাও ১৮ অক্টোবর ২০২৪ চলে গেলেন! আমি বলি—শ্যাম’দা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনজন সংগীত পরিচালকের মধ্যে সর্বশেষ, যিনি আমাদের একা করে দিয়ে চলে গেলেন!
আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম! এই শূন্যতা কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। সুজেয় শ্যাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, শ্রদ্ধায়।
লেখকঃ সংগীতশিল্পী
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)