শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১


ইসলামে নেকাব কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত:২১ জানুয়ারী ২০২৪, ১৭:২০

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

পর্দা ইসলামের ফরজ বিধান। চেহারা হলো পর্দার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা মুখমণ্ডল হচ্ছে দেহের সুন্দরতম অঙ্গ। এটি পর-পুরুষের সামনে ঢেকে না রাখলে পর্দার উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। চেহারা ঢেকে রাখার জন্যই মূলত নেকাব পরা হয়। তাই পর্দাপালনে নেকাবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে মনে করেন, পর্দা পালনে মুখ ঢেকে রাখার প্রয়োজন নেই। তাদের ধারণা ভুল।

আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুলকে (স.) সম্বোধন করে বলেছেন- یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ ‘হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রী, মেয়ে ও মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের জিলবাব (বড় চাদর)-এর কিছু অংশ তাদের উপর ঝুলিয়ে দেয়।’ (সুরা আহজাব: ৫৯)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- أمر الله نساء المؤمنين إذا خرجن من بيوتهن في حاجة أن يغطين وجوههن من فوق رؤوسهن بالجلابيب ويبدين عينا واحدة ‘আল্লাহ মুমিনদের নারীদেরকে আদেশ দিয়েছেন, তারা যখন ঘর থেকে বের হবে তখন তারা পুরো চেহারা ঢেকে বের হবে। তবে শুধু এক চোখ খোলা রাখবে। (তাফসিরে তবারি: ২০/৩২৪)

ইসমাঈল ইবনে উলাইয়্যা জিলবাবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি চাদর নিলেন এবং ঘোমটার মতো পরে মাথা মুখ ঢেকে ফেললেন। কপাল, নাক ও বাম চোখও ঢাকলেন। ডান চোখ খোলা রাখলেন। এরপর বললেন, এভাবে আমাদেরকে চাদর পরে দেখিয়েছেন আবদুল্লাহ ইবনে আওন আলমাজানি, তাকে দেখিয়েছেন (বিখ্যাত তাবেয়ি) মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন, তাকে দেখিয়েছেন আবিদা সালমানি (রহ) (যিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর শাগরিদ ও শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ি)। (তাফসিরে তাবারি: ১০/৩৩২; তাফসিরে ইবনে কাসির: ৩/৮২৫)

প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা জমাখশারি (রহ) বলেন- ومعنى يُدْنِينَ عَلَيْهِنّ مِنْ جَلَابِيبِهِنّ يرخينها عليهنّ، ويغطين بها وجوههنّ وأعطافهنّ. يقال: إذا زل الثوب عن وجه المرأة: أدني ثوبك على وجهك ‘আয়াতের অর্থ হলো- তারা নিজেদের উপর জিলবাব ঝুলিয়ে দেবে এবং চেহারা ঢেকে নেবে।’ (তাফসিরে কাশশাফ: ৩/৫৬০)

আল্লামা বায়যাবি (রহ) বলেন- يغطين وجوههن وأبدانهن بملاحفهن إذا برزن لحاجة ‘প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে তারা তাদের চাদর দিয়ে নিজেদের চেহারা ও শরীর ঢেকে নেবে।’ (তাফসিরে বায়যাবি: ৪/৩৮৬)

ইমাম আবু বকর রাজি আলজাসসাস (রহ) লিখেছেন-‘এই আয়াত থেকে প্রমাণ হয়, বাইরে বের হওয়ার সময় পরপুরুষের দৃষ্টি থেকে নারীর মুখমণ্ডল আবৃত রাখা এবং পর্দানশীন পবিত্র নারীর বেশ গ্রহণ করা অপরিহার্য, যাতে দুষ্ট লোকেরা তাদের প্রতি উৎসাহী না হয়।’ (আহকামুল কোরআন, জাসসাস: ৩/৩৭২; আলকাশশাফ, জামাখশারি: ৩/৩৭৪; তাফসিরে বায়যাবি: ২/২৮০; তাফসিরে জালালাইন: ৫৬০; তাফসিরে গারাইবুল কোরআন ওয়া রাগাইবুল ফুরকান: ৫/৪৭৬)

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ) বলেন-‘সঠিকতর সিদ্ধান্ত এই যে, নারীর জন্য পরপুরুষের সামনে দুই হাত, দুই পা ও মুখমন্ডল খোলা রাখার অবকাশ নেই।’ (মাজমুউল ফতোয়া: ২২/১১৪)

ইবনুল কাইয়িম (রহ) বলেন, ‘নারী নামাজ আদায়ের সময় দুই হাত ও মুখমন্ডল খোলা রাখতে পারেন, কিন্তু এভাবে বাজারে ও লোকের সমাগমস্থলে যাওয়ার অবকাশ নেই।’ (ইলামুল মুয়াক্কিয়িন: ২/৪৭)

আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত রাখতাম।...’ (আলমুসতাদরাক হাকিম: ১/৪৫৪)

উল্লেখিত দলিলাদি থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, নারীদের জন্য মুখ ঢেকে রাখা পর্দার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান বিশ্বের অনেক ইসলামি রাষ্ট্রেও চেহারা ঢাকাকে বিভিন্ন অজুহাতে ছোট করে দেখা হয়, গুরুত্বহীন বিবেচনা করা হয়। অথচ কোরআনের পর্দাই মুসলিম নারীদের দিয়েছে নেকাব-বোরকা। এই বিধানকে হেয় করার সুযোগ ইসলাম কাউকে দেয়নি। জরুরি প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা। যেমন- আইডি কার্ড বানানোর জন্য ছবি তোলা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে চেহারা খোলা রেখে ছবি তোলা জায়েজ। তবে এক্ষেত্রেও যতটা ছবি তোলা প্রয়োজন, ঠিক ততটাই তোলা জায়েজ, এর অতিরিক্ত নয়। অন্যান্য প্রয়োজনেও ঠিক ততক্ষণ চেহারা খোলা রাখা যাবে, যতক্ষণ খোলা না রাখলে প্রয়োজন পুরা হয় না। কেননা জরুরি প্রয়োজনে ছাড় দেয় ইসলামি শরিয়ত। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর কেউ সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে নিরুপায় হয়ে পড়লে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা নাহল: ১১৫)

ইহরাম অবস্থায় পরপুরুষ না থাকলে চেহারা খোলা রাখতে হয় নারীদের। কিন্তু পুরুষ দেখে ফেলার সম্ভাবনা থাকলে ইহরাম অবস্থায়ও নারী সাহাবিরা চেহারা ঢেকে ফেলতেন এবং এটিই সঠিক পদ্ধতি। যেমনটি উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) তাঁর হজের বিবরণে বলেছেন, ‘ইহরামের কারণে তারা নেকাব খোলা রাখতেন, কিন্তু যখন পুরুষেরা নিকট দিয়ে অতিক্রম করত তখন তারা মুখমন্ডল আবৃত করে ফেলতেন। তারা চলে যাওয়ার পর নেকাব তুলে ফেলতেন।’ (মুসনাদে আহমদ ৬/৩০; সুনানে আবু দাউদ: ১৮৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৭৫৭)

মনে রাখা জরুরি- ইসলামের কোনো সাধারণ বিষয় নিয়েও হাসি-তামাশা করার অবকাশ নেই। অনেকের মধ্যে ইসলামি পোশাক টুপি, বোরকা, নেকাব ইত্যাদি নিয়ে রসিকতা করার বদভ্যাস রয়েছে। যা খুবই খারাপ দিক। এই বদভ্যাস বান্দার সব আমল বাতিল করে দিতে পারে। এমনকি ইসলাম থেকেই বের করে দিতে পারে। এজন্যই আলেমরা সতর্ক করে বলেন, মুনাফেকদের প্রথম পরিচয় ছিল- তারা মুসলমানদের নিয়ে হাসি তামাশা করত, তাদের বোকা ভাবত। আল্লাহ পাক সেসব মুনাফেকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তারাই বোকা অথচ নিজেরা তা জানে না।’ (সুরা বাকারা: ১৩)

ইমাম ইবনে কুদামাহ লিখেছেন, ‘যে আল্লাহকে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গালি দিল, কিংবা যে আল্লাহ বা তার রাসুল কিংবা দ্বীনের কোনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করল, সে কাফের হয়ে গেল।’ ইমাম নববি বলেন, ‘স্বেচ্ছায় কিংবা কেউ যদি স্পষ্টভাবে এমন কোনো কথা বলে যা আল্লাহ ও তার রাসুলের কোনো বিধানকে তুচ্ছ করে, তা অবশ্যই কুফুরি।’ ইমাম কুরতুবি লিখেছেন, ‘মজা করার জন্য হোক বা সত্যি সত্যি হোক, ইসলামের কোনো সাধারণ বিষয় নিয়ে হাসি তামাশা করাও কুফুরি—এতে কারো দ্বিমত নেই।’

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘দ্বীনের যে কোনো স্পষ্ট বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করা কুফুরি; যে এমন করল তার ইমান ধ্বংস হয়ে কুফুরিতে পরিণত হল।’ এসব ঠাট্টাকারীদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবে, আমরা একটু হাসি তামাশা করছিলাম। আপনি বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহকে নিয়ে এবং তার আয়াতসমূহ ও তার রাসুলকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছ? তোমরা কারণ দেখিয়ো না, তোমরা তো তোমাদের ঈমানের পরও কুফুরি করে ফেলেছো।’ (সুরা তওবা: ৬৫-৬৬)

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:৫৮ ভোর
যোহর ১১:৪৫ দুপুর
আছর ০৩:৩৬ বিকেল
মাগরিব ০৫:১৫ সন্ধ্যা
এশা ০৬:৩১ রাত

শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪