শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১ ভাদ্র ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
সুরা বাকারায় বনী ইসরাঈলের গরু জবাই সম্পর্কিত একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। কোরআন ও তাফসির গ্রন্থগুলোর বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনাটি তুলে ধরা হলো—
বনী ইসরাইলের একজন বিত্তশালী ব্যক্তি ছিলেন আমীল। শুধু একজন চাচাতো ভাই ছাড়া তার আর কোনো স্বজন ছিল না। সেই চাচাতো ভাই ছিল লোভী প্রকৃতির। আমীলের সম্পত্তির প্রতি তার কুনজর ছিল। সে আমীলকে হত্যা করে তার পুরো সম্পত্তির মালিক হতে চেয়েছিল।
সুযোগ বুঝে একদিন আমীলকে হত্যাও করে ফেললো তার চাচা ভাই। তারপর তার লাশ গোপনে অন্য এক গ্রাম সংলগ্র মাঠে রেখে এলো । পরদিন সে চিৎকার করে লোক জড়ো করে জানালো, আমীলের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। জনসম্মুখে সে কান্নাকাটি শুরু করলো।
সবাই মিলে আমীলের লাশ খোঁজা শুরু করলো। সেই গ্রাম সংলগ্ন মাঠে তার লাশ পাওয়া গেলো। সেই গ্রামের কয়েকজনের ওপর খুনের দায় চাপালো আমীলের চাচাতো ভাই।
হজরত মুসা (আ.) এই ঘটনা জানতে পেরে অভিযুক্তদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। কিন্ত তারা কোনোক্রমেই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানালো। তখন জনতা হজরত মুসা (আ.)-কে বললো—
হে আল্লাহর নবী মুসা! প্রকৃত হত্যাকারীর সন্ধান পেতে এবং এই সমস্যার সমাধানে আপনি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করুন।
হজরত মুসা (আ.) আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করলেন। এরপর তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশে জানিয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে একটি গরু জবাই করতে বলেছেন। আল্লাহর এই আদেশে যে হিকমত লুকিয়ে ছিল তারা তা বুঝতে পারেনি। তারা কোনোভাবে হত্যার ঘটনার সঙ্গে গরু জবাইয়ের যোগসূত্র মিলাতে পারছিল না। তাই তারা বললো, মুসা! তুমি কি আমাদের সঙ্গে উপহাস করছো?
তাদের এমন হঠকারিতামূলক মন্তব্য শুনে হজরত মুসা (আ.) বললেন, আল্লাহর আদেশ আমি তোমাদের জানিয়ে দিয়েছি, বাকিটা তোমাদের ইচ্ছা। আমি তোমাদের এই হঠকারিতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
মুসা (আ.)-এর কাছে এমন জবাব শুনে তারা বুঝতে পারলো, আল্লাহর এই হুকুম অবধারিত ও তা পালন করতে হবে। যেহেতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গরু জবাইয়ের বিষয়টি জড়িত তাই এটি বিশেষ কোনো গরু হবে বলে ধারণা করলো তারা।
তাই তারা জবাইযোগ্য গরুর আকৃতি-প্রকৃতি কেমন হবে সে সম্পর্কে বিভিন্নরকম প্রশ্নের করলো মুসা (আ.)-এর কাছে। তারা যেকোনো একটি গরু জবাই করলেই হয়ে যেতো। কিন্তু বিষয়টি জটিল করে তারা মুসা (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলো গরুটি দেখতে কেমন হবে, গায়ের রঙ কেমন হবে?
তাদের এমন অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দিলেন। গরুটির গুণাবলীও বর্ণনা করা হলো যে— সেটা এমন গাভী হতে হবে যা বৃদ্ধও নয়, অল্পবয়স্কও নয়, মধ্যবয়সী। গরুর গায়ের রঙ হতে হবে উজ্জ্বল গাঢ় ও হলুদ বর্ণের— এমন রঙ যা দেখেই মানুষ পছন্দ করবে।
গাভীর আরেকটি বিশেষ গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে— এটা এমন এই গাভী হতে হবে যা কখনো জমিতে চাষ ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি এবং তা সুস্থ ও নিখুঁত হতে হবে।
প্রথমে যেকোনো গরু জবাই করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো কিন্তু প্রশ্নের মাধ্যমে বিষয়টি জটিল করে তারা শর্তানুরূপ গরু খুঁজতে শুরু করলো।
বনী ইসরাইলদের মধ্যে একজন অত্যন্ত সৎকর্মপরায়ণ লোক ছিলেন। তার একটি শিশু সম্ভান ও একটি গরুর বাছুর ছিল। মৃত্যুর আগে তিনি একটি জঙ্গলের পাশে বাছুরটি রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন— হে দয়াময়! এই বাছুরটি আমি আমার শিশু সন্তান যুবক হওয়া পর্যন্ত গচ্ছিত রাখলাম । তখন থেকে বাছুরটি জঙ্গলে আপনা-আপনি চরে বেড়াতে লাগলো। মানুষের পদশব্দ পেলেই সে লোকচক্ষুর অন্তরালে পালিয়ে যেতো। তাই কেউ চেষ্টা করলেও সেটিকে ধরতে পারতো না। ইতোমধ্যে সেই সৎ লোক মারা গেলো। তার শিশু সন্তানও যুবক হলো।
সে খুব সৎ ছিল। রাত জেগে ইবাদত করতো। মায়ের সেবা করতো। সকালে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করতো। উপার্জনের টাকা তিন ভাগ করে এক ভাগ আল্লাহর রাস্তায় দান করতো। এক ভাগ মায়ের জন্য খরচ করতো। বাকি এক ভাগ নিজের প্রয়োজনে খরচ করতো।
একদিন তার মা তাকে বললেন, তোমার বাবা তোমার জন্য তোমার জন্য একটি গাভী রেখে গেছেন। ওমুক জঙ্গলে গাতীটি আল্লাহর হেফাজতে রয়েছে। সে ওই জঙ্গলে গিয়ে গাভীটি খুঁজে পেলো। সে গাভী নিয়ে বাড়িতে গেলো।
এদিকে আমীলের হত্যাকারীর সন্ধান পেতে মুসা (আ.)-এর বর্ণিত গুণাবলী সম্পর্কিত গাভী খোঁজ করছিল তার এলাকার লোকেরা। খুঁজতে খুঁজতে তারা দেখলো, এই যুবকের গাভীর মাঝেই সেই সব গুণাবলী বিদ্যমান। তারা তখন তার কাছ থেকে চড়া মূল্যে গাভীটি কিনে নিলো। এরপর গাভী জবাই করে তার একটি অংশ মৃতের শরীরে স্পর্শ করালো। তিনি তাৎক্ষণিক জীবিত হয়ে হত্যাকারীর নাম জানিয়ে আবার মারা গেলেন।
(সুরা বাকারা, আয়াত : ৬৭-৭৩, তাফসিরে মাযহারী, ১/১৫৭-১৬২)
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)