শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
কোরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা কোরবানির নির্দেশ দিয়ে বলেন— ‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা কাউসার: ২) কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য বা কোরবানি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে কিছু ভুল থেকে বেঁচে থাকা জরুরি। অন্যথায় কোরবানি শুদ্ধ হবে না, আল্লাহর দরবারে তা গৃহীতও হবে না।
নিয়ত বিশুদ্ধ না হওয়া
কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার জন্য নিয়তের বিশুদ্ধতা জরুরি। কোরবানি হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। অন্যকারো সন্তুষ্টি অথবা লোকদেখানো উদ্দেশ্য অথবা কম টাকায় অধিক গোশত বা ভালো গোশত পাওয়া যাবে—এধরণের নিয়তে কোরবানি করলে ওই কোরবানি শুদ্ধ হবে না; কবুলও হবে না। তবে, কোরবানি শেষে গোশত খাবো—এধরণের কামনা অন্তরে বিরাজ করলে কোরবানি অশুদ্ধ হবে না। (সুরা হজ: ৩৭; মুসনাদে আহমদ: ২২৯৮৪; আল ফতোয়াল কুবরা, সদরুশ শহিদ: ১/২১৪; খুলাসাতুল ফতোয়া: ৪/৩১৩)
পশু জবাই করার সময় মুখে নিয়ত করা জরুরি নয়। অবশ্য মনে মনে নিয়ত করবে যে আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করছি। তবে মুখে দোয়া পড়া উত্তম। (ফতোয়ায়ে শামি : ৫/২৭২)
হারাম টাকায় কোরবানি করা
কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকায় কোরবানি করলে ওই কোরবানি শুদ্ধ হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না।’ (সুরা বাকারা: ৪২) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না।’ (সহিহ মুসলিম: ১০১৫)
পশুর বয়স শরিয়ত নির্ধারিত বয়সের কম হওয়া
তিন শ্রেণির চতুষ্পদ জন্তু দিয়ে কোরবানি করা যাবে। যেমন ১. ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। ২. গরু, মহিষ। ৩. উট। তাদের আবার নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে। এর কমে কোরবানি শুদ্ধ হয় না। উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর হতে হবে। ছাগলের বয়স একবছর হতে হবে। ভেড়া ও দুম্বার বয়সও এক বছর তবে সংকটের সময় ৬ মাসের হলে সমস্যা নেই। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা কোরবানির পশু ‘মুসিন্না’ ছাড়া জবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছয় মাস বয়সের ভেড়া-দুম্বা জবেহ করতে পারবে। (মুসিন্না হলো- পাঁচ বছর বয়সী উট, দুই বছরের গরু, মহিষ এবং এক বছর বয়সী ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা। (সহিহ মুসলিম: ১৯৬৩; আবু দাউদ: ২৭৯৭; ইবনে মাজাহ: ৩১৭৯)
ত্রুটিপূর্ণ পশু কোরবানি করা
কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য পশু হতে হবে বড় ধরনের দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। হাদিসে এসেছে, ‘চার ধরনের পশু দিয়ে কোরবানি হবে না। অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট; রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট; পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট ও আহত, যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ ( ইবনে মাজাহ: ৩১৪৪)
জেনে রাখা জরুরি- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ নয়। (ফতোয়া কাজিখান: ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫)
পশুর গলার ৩ রগ না কাটা
জবাই করার সময় চারটি রগ কাটা জরুরি: ১. কণ্ঠনালি, ২. খাদ্যনালী, ৩. দুই পাশের মোটা রগ, যাকে ওয়াজদান বলা হয়। এই চারটি রগের মধ্যে যেকোনো তিনটি কাটা হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি দুটি কাটা হয় তবে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (হেদায়া: ৪/৪৩৭)
জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ না বলা
কোরবানির পশু জবাইয়ের সময় ইচ্ছাকৃত বিসমিল্লাহ না বললে কুরবানি হবে না। কিন্তু যদি ভুলে বিসমিল্লাহ না বলে, তাহলে কুরবানি হয়ে যাবে। (সুরা আনআম: ১২১; ইবনে মাজাহ: ২০৪০; মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক: ৮৫৪০)
শরিকের সংখ্যা নির্ধারণ অশুদ্ধ হওয়া
একটি উট অথবা গরু-মহিষে সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তি কোরবানির জন্য শরিক হতে পারে। (মুসলিম: ১৩১৮) ইমাম শাওকানি (রহ) বলেন, হজের কোরবানিতে দশ এবং সাধারণ কোরবানিতে সাত ব্যক্তি শরিক হওয়াটাই সঠিক। (নাইলুল আওতার: ৮/১২৬) কিন্তু মেষ বা ছাগলে ভাগাভাগি বৈধ নয়। আবার বড় পশুতে সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগেও কোরবানি জায়েজ। কিন্তু সাতের অধিক লোকের শরিকে কোরবানি শুদ্ধ নয়। (মুসলিম: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)
শরিকের কোরবানির অর্থ হারাম হওয়া
জেনেশুনে হারাম উপার্জনকারীকে কোরবানির অংশীদার করলে অন্য শরিকদের কোরবানিও সহিহ হবে না। (সুরা বাকারা: ৪২; মুসলিম: ১০১৫) তবে, বিষয়টি অন্য শরিকদের অজানা থাকলে তাদের কোরবানি শুদ্ধ হবে, শুধুমাত্র হারাম টাকার অংশীদারের কোরবানি কবুল হবে না। (সুরা বাকারা: ২৮৬)
শরিকের নিয়ত অশুদ্ধ হওয়া
ইসলামি শরিয়তের বিধান হলো- শরিকের মধ্যে শুধু একজনের নিয়তে গণ্ডগোল থাকলে কারো কোরবানিই শুদ্ধ হবে না। এ বিষয়ে ফতোয়ার কিতাবগুলোতে বলা হয়েছে—যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে কোরবানি করবে, তাহলে তার কোরবানি সহিহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরিকদের কারো কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরিক নির্বাচন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯) তবে, নিয়ত অশুদ্ধের বিষয়টি অন্য শরিকদের অজানা থাকলে তাদের কোরবানি হবে, শুধু তার কোরবানি হবে না। (সুরা বাকারা: ২৮৬)
ভাগবণ্টনে গরমিল করা
কোরবানির পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭) প্রসঙ্গত, অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। পা ও মাথার ক্ষেত্রেও একই বিধান। তবে কেউ যদি নিজের ভাগের অংশ অন্যজনকে দিয়ে দেয়, তাতে সমস্যা নেই (আদ্দুররুল মুখতার: ৬/৩১৭, কাজিখান: ৩/৩৫১)
কোরবানির বর্জ্য যত্রতত্র ফেলে রাখা
কোরবানির বর্জ্য পরিস্কার না করা খুবই বাজে অভ্যাস। এটি কদর্য অন্তরের পরিচায়ক। যদিও এর সঙ্গে কোরবানি হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক নেই। কিন্তু কোরবানির পর পশুর রক্ত, বর্জ্য, বিভিন্ন খণ্ডিত অংশ যত্রতত্র ফেলে দেওয়া কঠিন গুনাহের কাজ। এতে মানুষকে কষ্ট দেয়া হয়। আর আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দেয়া খুবই অপছন্দ করেন। মনে রাখতে হবে, বর্জ্যের কারণে পচা দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, নালা নর্দমায় ফেলে দিলেও সমান কষ্ট হয়। তাই বর্জ্য অপসারণে নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পালন করতে হবে। এই দায়িত্বে অবহেলা কোনোভাবেই প্রকৃত মুসলমানের জন্য শোভনীয় নয়। আল্লাহ আমাদের উল্লেখিত সবগুলো কজের ব্যাপারে সাবধানতা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)