শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আবু উসামা যায়িদ। হিব্বু রাসূলিল্লাহ (রাসূলুল্লাহর প্রীতিভাজন) তাঁর উপাধি। পিতা হারিসা এবং মাতা সুদা বিনতু সালাব। আট বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ির যাওয়ার পথে লুটেরাদের কবলে পড়ে তাদের কাফেলা। ধন-সম্পদ লুট করে যায়িদকে দাস হিসেবে বন্দী করে মক্কার উকাজ নামক মেলার বাজারে বিক্রি করে দেয় ডাকাত দল।
খাদিজা রা.-এর ভাতিজা হাকীম ইবনে হিযাম ইবনে খুয়াইলিদ উকাজ মেলা থেকে যায়িদকে কিনে ফুফুকে উপহার দেন। খাদিজা ভাতিজার কাছ থেকে উপহার পাওয়া এই দাসকে রাসূল সা.-এর হাতে তুলে দেন। এরপর থেকে রাসূলের কাছে প্রতিপালিত হতে থাকলেন যায়িদ। তাঁর কাছ থেকে শিখলেন উত্তম চরিত্র ও মানবিকগুণ। পরিবার হারিয়েও আনন্দে সময় কাটতে লাগলো তাঁর।
এদিকে ছেলেকে হারিয়ে অস্থির হয়ে উঠেন যায়িদের মা। যায়িদের বাবা সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেও সন্ধান পেলেন না। সেই বছর হজের মৌসুমে যায়িদের গোত্রের কিছু লোক মক্কায় এলেন হজ করতে। কাবা তাওয়াফের সময় হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা। হজ শেষে ফিরে গিয়ে যায়িদের বাবাকে তার সন্ধান দিলেন।
সন্ধান পেয়ে ছেলের মুক্তিপণের জন্য নগদ অর্থসহ নিজের ভাই কাবকে নিয়ে রাসূল সা.-এর কাছে গেলেন তিনি। বললেন,
হে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। অসহায়ের সাহায্যকারী, ক্ষুধার্তকে অন্নদানকারী ও আশ্রয়প্রাথীর্কে আশ্রয় দানকারী। আপনার কাছে আমাদের ছেলে আছে তাকে নিতে এসেছি, সঙ্গে মুক্তিপণও এনেছি। আপনি ইচ্ছামতো মুক্তিপণ নিয়ে আমার ছেলেকে দিয়ে দিন।
রাসূল সা. বললেন, মুক্তিপণের প্রয়োজন নেই, যায়িদ যদি আপনাদের সঙ্গে যেতে চায় তাহলে নিয়ে যান। আর আমার সঙ্গে থেকে যেতে চাইলে আামর কিছু করার নেই। এরপর তাঁকে ডেকে জানতে চাওয়া হলো বাবার সঙ্গে যাবে কি না?
তিনি মুহাম্মদ সা.-এর কাছে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। এতে বাবা কষ্ট পেলেন। যায়িদ বাবাকে বললেন, আমি এই ব্যক্তির ভেতর এমন কিছু দেখেছি যা অন্য কারো মাঝে দেখিনি।
যায়িদের সিদ্ধান্তের পর রাসূল সা. তাঁকে নিয়ে কাবাপ্রাঙ্গণে গেলেন, উপস্থিত কুরাইশদের সামনে ঘোষণা দিলেন, তোমরা জেনে রেখো, আজ থেকে যায়িদ আমার ছেলে। সে হবে আমার এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী।
মক্কার বিশস্ত মুহাম্মদের কাছ থেকে এমন ঘোষণায় খুশি হলেন যায়িদের বাবা ও চাচা। তারা প্রশান্ত চিত্তে ফিরে গেলেন নিজের গোত্রে। এরপর থেকে যায়িদের নাম হলো যায়িদ ইবনে মুহাম্মদ। সবাই তাকে মুহাম্মদের ছেলে হিসেবেই সম্বোধন করতে লাগলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের — তাদেরকে পিতার নামেই ডাকো— আয়াত নাজিলে মাধ্যমে ধর্মপুত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করেন। এরপর তিনি আবার যায়িদ ইবনে হারিসা নামে পরিচিতি লাভ করেন।
রাসূল সা. নবুয়ত লাভের পর সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের কাতারে নাম লেখানোর সৌভাগ্য লাভ করেন তিনি। তিনি পুরুষ দাসদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। পরবর্তীতে তিনি রাসূল সা.-এর বিশ্বাসভাজন আমিন, তাঁর সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার ও তাঁর অনুপস্থিতিতে মদিনার অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পান।
রাসূল সা. যায়িদকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। যায়িদ দূরে কোথাও গেলে তিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠতেন, ফিরে এলে প্রফুল্ল হতেন। তাঁর সঙ্গে যেভাবে আনন্দে দেখা করতেন অন্য কারো সঙ্গে সাক্ষাতের সময় রাসূলকে এতোটা খুশি দেখা যেতো না।
কোনো এক অভিযান শেষে তিনি মক্কায় ফিরে এলে রাসূল সা. তাঁকে যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন আয়েশা রা.। তিনি বলেন—
যায়িদ ইবনে হারিসা মদিনায় ফিরে এলো। রাসূল সা. তখন আমার ঘরে। সে দরজায় কড়া নাড়লো। রাসূল সা. প্রায় খালি গায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তখন তাঁর দেহে নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত এক প্রস্থ কাপড় ছাড়া আর কিছু ছিল না। এ অবস্থায় কাপড় টানতে টানতে তিনি দরজার দিকে দৌঁড়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গে গলাগলি করলেন ও চুমু খেলেন। আল্লাহর কসম! এর আগে বা পরে আমি কখনো রাসূল সা.-কে এমন খালি গায়ে দেখিনি।
যায়িদের প্রতি রাসূল সা.-এর ভালোবাসার কথা সাহাবিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে তাঁকে সবাই যায়িদ আল হুব্ব বলে সম্বোধন করতেন। তাঁকে হিব্বু রাসূলিল্লাহ বা রাসূল সা.-এর প্রীতিভাজন উপাধি দেওয়া হয়।
হজরত হামজা রা. ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর সঙ্গে ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন রাসূল সা.। উম্মু আয়মন নামে রাসূল সা.-এর এক দাসী ছিলেন। একদিন তিনি সাহাবিদের বলেন, কেউ যদি জান্নাতি কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চাও তাহলে উম্মু আয়মানকে বিয়ে করো। এ কথা শুনে যায়িদ তাকে বিয়ে করেন। তার গর্ভেই জন্ম গ্রহণ করেন প্রখ্যাত মুসলিম সেনানায়ক সাহাবী উসামা ইবনে যায়িদ রা.।
মুতার যুদ্ধে নবীজি যায়িদ ইবনে হারিসা রা.-কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এই যুদ্ধে (৮ম হিজরিতে) তিনি শহীদ হন। শাহাদাতের কথা শুনে নবীজি তাঁর বাড়িতে যান সমবেদনা জ্ঞাপনের জন্য। বাড়িতে গিয়ে তাঁর মেয়ের কান্না দেখে তিনি নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। তাঁর চোখ দিয়েও অশ্রু ঝরতে শুরু করে।
(আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ১/১২৫)
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)