সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২
ছবি : সংগৃহীত
হীরার আংটি এখন প্রেম ও বাগদানের চিরন্তন প্রতীক। তবে এ মর্যাদা হঠাৎ করে আসেনি- এর পেছনে রয়েছে উপনিবেশবাদ, একচেটিয়া ব্যবসা ও শক্তিশালী বিজ্ঞাপনের দীর্ঘ ইতিহাস।
ডি বিয়ার্সের উত্থান
১৮৭০ সালে অক্সফোর্ডের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে যুবক সিসিল রোডস দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনিতে যান। প্রথমে খনিশ্রমিকদের কাছে পানি তোলার পাম্প ভাড়া দিয়ে শুরু করলেও শিগগিরই চার্লস রাডকে সঙ্গে নিয়ে শত শত ছোট খনি ও জমি কিনে নেন। লন্ডনের রথসচাইল্ড ব্যাংকের সহায়তায় বিশাল মূলধন জোগাড় করে তারা ছোট খনিগুলো একীভূত করে গড়ে তোলেন ডি বিয়ার্স কনসোলিডেটেড মাইনস।
১৮৮৮ সালের মধ্যে ডি বিয়ার্স দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সব হীরার খনির মালিকানা নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৯০০ সালের দিকে দেশটির মোট রপ্তানির ২৫ শতাংশ ছিল হীরা, আর বিশ্বের ৯০ শতাংশ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করত ডি বিয়ার্স। এ সময় রোডস কেপ কলোনির প্রধানমন্ত্রীও হন। শ্বেতাঙ্গদের মালিকানাধীন এই কোম্পানির লাভের ভাণ্ডার গড়ত কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের অতি স্বল্প মজুরিতে কাজের ভিত্তিতে।
রোডসের মৃত্যুর পর ১৯০২ সালে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন আর্নেস্ট ওপেনহাইমার। তিনি বিশ্বজুড়ে হীরার ব্যবসা প্রায় পুরোপুরি ডি বিয়ার্সের লন্ডনভিত্তিক সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশনের অধীনে নিয়ে আসেন। ১৯৩০-এর দশক নাগাদ ডি বিয়ার্স বৈশ্বিক সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে একচ্ছত্র ক্ষমতা অর্জন করে।
হীরা চিরন্তন: বিজ্ঞাপনের জাদু
১৯৪৭ সালে মার্কিন বিজ্ঞাপন সংস্থা এনডব্লিউ আয়ার তৈরি করে কিংবদন্তি স্লোগান- ‘A Diamond is Forever’। এটি হীরাকে প্রেম ও বাগদানের প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করে। সিনেমা, বিজ্ঞাপন ও সেলিব্রিটিদের গহনার মাধ্যমে ধারণাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১০ শতাংশ কনে হীরার আংটি পেতেন, যা ১৯৮০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ শতাংশে। জাপানে ১৯৬০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫ শতাংশেরও কম, যা ১৯৮১ সালে ৬০ শতাংশে পৌঁছায়।
১৯৫০-এর দশকে একটি হীরার আংটির গড় দাম ছিল ১৭০ ডলার। ডি বিয়ার্স শুরুতে এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ খরচের পরামর্শ দিলেও ১৯৮০-এর দশকে বিজ্ঞাপন প্রচারণায় বলা হয়-‘কীভাবে দুই মাসের বেতন চিরকাল টিকে থাকতে পারে?’
বিতর্ক ও পতন
১৯৭০-এর দশক নাগাদ ডি বিয়ার্স বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ক্যারাট হীরা বিতরণ করত। তবে একই সময়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে কার্টেল আচরণ ও বর্ণবাদী শ্রমনীতি বজায় রাখার অভিযোগ। ১৯৯০-এর দশকে আরও বড় আঘাত আসে যখন প্রকাশিত হয়, আঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন ও কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহীরা হীরা বিক্রি করে অস্ত্র কিনছে। এতে ‘ব্লাড ডায়মন্ডস’ শব্দটির প্রচলন ঘটে। ডি বিয়ার্স সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এ ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়ে।
ফলস্বরূপ, ১৯৯৯ সালে কোম্পানির বিক্রি ৫.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০০১ সালে নেমে আসে ৪.৪৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তাদের সিএসও ভেঙে যায় এবং একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শেষ হয়।
সমালোচনার জবাবে ২০০৩ সালে ডি বিয়ার্স কিম্বারলি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সহায়তা করে, যাতে হীরার উৎস যাচাই করা যায় এবং সংঘর্ষপূর্ণ অঞ্চলের হীরা বাজারে ঢুকতে না পারে।
আধুনিক সংকট
আজ প্রাকৃতিক হীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়েছে সস্তা ল্যাব-উৎপাদিত হীরা ও বিকল্প রত্নের কাছে, যা প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সস্তা। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক হীরা বাণিজ্য ২৫ শতাংশ কমে দাড়ায় ২৪.৪ বিলিয়ন ডলারে। ভারতের সুরাটে ৫০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, অন্তত ৮০ জন আত্মহত্যাও করেছেন।
২০১১ সালে ওপেনহাইমার পরিবার তাদের অংশ অ্যাংলো আমেরিকানের কাছে বিক্রি করে। বর্তমানে কোম্পানিটি আবার বিক্রির জন্য বাজারে রয়েছে।
তবুও, বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের কাছে হীরার বাজার এখনও বিশাল। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক বিক্রি ছাড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে একটি হীরার আংটির গড় দাম ৬৭৫০ ডলার, যা আমেরিকানদের গড়ে দেড় মাসের আয়ের সমান হলেও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য প্রায় আট মাসের বেতনের সমপরিমাণ। আর ধনীদের জন্য বাজারে রয়েছে ২২৮ ক্যারেটের বিরল হীরা, যার দাম অনুমান করা হচ্ছে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)