বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স যেন আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের দৈত্যে ঠাসা। প্রদীপ ঘষলেই নগদ অর্থসহ ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ি মেলে এখানে। রেজিস্ট্রি অফিসের ঝাড়ুদার-সুইপার-উমেদার থেকে নকল-নবিশ, সাব-রেজিস্ট্রার প্রায় প্রত্যেকেই কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে কেউ কারো থেকে কম যান না এখানে। আশ্চর্য্য প্রদীপের সন্ধান পাওয়া তেমনই এক সৌভাগ্যবান উমেদার ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের রানা আহমেদ।
গত ২৪ মার্চ উমেদার রানার নামে দুদকে লিখিত অভিযোগ করেছেন জনৈক ব্যক্তি। অভিযোগপত্রে রানাকে একসময়কার ‘চা বিক্রেতা’ উল্লেখ করে বর্তমানে তার ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধ্যানপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। শুধু তা-ই নয়; নিবন্ধন অধিদপ্তরের ডিজি, জেলা রেজিস্ট্রার ঢাকা এবং ধানমন্ডির সাব-রেজিস্ট্রার বরাবর ওই অভিযোগের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।
দুদকে দাখিল করা অভিযোগে থেকে জানা গেছে, ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক থেকে শুরু করে সহকর্মী-পিওন, নকল নবীশদের ভয়ভীতি দেখিয়ে গোটা অফিস জিম্মি করে রেখেছেন উমেদার রানা আহমেদ। দলিল দাতা-গ্রহিতা ও দলিল লেখকদের জিম্মি করে প্রতিদিন লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। অথচ রানার বিরুদ্ধে কেউ টু-শব্দ করার সাহস করেন না। ঘুষের বিনিময়ে জমির শ্রেণি পরিবর্তন, নাল জমিকে ভিটি, ভিটি জমিকে বাড়িতে রূপান্তর করাই হচ্ছে রানার কাজ। ওয়ারিশ নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতায় ঘুষ লেনদেন, দলিলের নকল, ভোটার আইডি জটিলতা, ভলিউমে ঘষামাজা করা, দলিলে দাগ ফেলা বা পাতা হারানো, বড় অঙ্কের লেনদেন হলে পুরো ভলিউম গায়েব করা, কারও নাম বা পিতার নামের অক্ষরে এদিক-সেদিক হলেই ভুক্তভোগীকে ভুলের খেসারত গুণতে হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে। আর এসব কাজে ঘুষ বাণিজ্য করে বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক রানা আহমেদ। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রিতে স্থানীয় কর, উৎসে কর সংক্রান্ত পে-অর্ডার নিয়ে সরকারি গেজেটে ধোঁয়াশার কারনে কোন দলিলে উৎসে কর দিতে হবে, কোনটায় দিতে হবে-না কীভাবে দিতে হবে? তা জানে না অনেকেই। এই সুযোগে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে উমেদার রানা। এছাড়াও সাফ কবলা, হেবা, বন্ধকী, কমিশন বা পাওয়ার যে দলিলই হোক না কেন- রানাকে ঘুষ না দিলে সেবা গ্রহীতাদের পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। আর হিস্যা পেলে জাল নামজারি, দাখিলা, পর্চা কিংবা জমির শ্রেণি পরিবর্তন কোন বিষয়ই না রানার কাছে। দৈনিক মাত্র ৬০ টাকা হাজিরায় উমেদার রানা এখন ফ্ল্যাট-বাড়ি, গাড়িসহ কয়েক কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়!
নাম পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে রানার এক সহকর্মী এ প্রতিবেদককে বলেন, উমেদার রানার স্বভাব-চরিত্র অনেকটা বস্তির উঠতি মাস্তানদের মতো। আচার-আচরনে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। যখন-তখন যার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। টাকার গরমে রানা নিজেকে একপ্রকার ‘হনু’ ভাবেন।
সূত্র মতে, একসময় তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের সামনে চা বিক্রি করতেন রানা আহমেদ। ওই সময় ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের ‘দুর্নীতিবাজ’ টাইপিষ্ট মতিউর রহমান (বর্তমান ময়মনসিংহের প্রধান সহকারী) সাবেক জেলা রেজিস্ট্রার আব্দুল জলিলকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে রানাকে ধানমন্ডি সাব রেজিস্ট্রি অফিসের উমেদার পদে নিয়োগ দেন। ব্যস, কিছুদিন পরই উমেদার রানা দুর্নীতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া শুরু করেন। দুর্নীতির অভিযোগে উমেদার রানাকে ঢাকার তৎকালীন জেলা রেজিস্ট্রার দিপক কুমার সরকার আশুলিয়া অফিসে বদলী করেন। ৩ মাস পর পুনরায় রানা ধানমন্ডি অফিসে যোগদান করে অফিসটি ঘুষ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। ধানমন্ডির সাব রেজিস্ট্রার আবুল হোসেনের নামে দলিল প্রতি প্রতিদিন আদায়কৃত ঘুষের টাকা সন্ধ্যার পর সাব-রেজিস্টারের বাসায় পৌছে দেন রানা। যে কারনে আবুল হোসেনের সঙ্গে রানার ব্যাপক সখ্যতা। রানা এখন ধরাকে সরাজ্ঞান করে দলিলে সামান্য ভুলভ্রান্তি দেখিয়ে দলিল মূল্যের উপর উৎকোচ আদায় অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করায় রানার এক সহকর্মীর সাথে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকায় আয়েশী জীবন-যাপন করছেন রানা আহমেদ। হাতিরঝিল মহানগর হাউজিংয়ের ৩য় তলায় ১৮শ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। একই ভবনে আরো একটি ফ্ল্যাট আছে রানার। এছাড়া রামপুরা বনশ্রীতে ৪তলা বিলাসবহুল বাড়ির মালিক তিনি। গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভুইয়ায় প্রায় ৩০ একর জমি ও ৫টি দোকান কিনেছেন তিনি। ৩টি মাইক্রোবাস কিনে ভাড়াও দিয়েছেন এবং রানা নিজে চলেন প্রাইভেট কারে।
এসব বিষয়ে রানার কাছে জানতে চাইলে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ প্রতিবেদককে বলেন, “আমার নামে যে বা যারাই অভিযোগ করেছে, তা মিথ্যা ও বানোয়াট। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগে আমার সম্পদের বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে- তার প্রমাণ দিতে পারলে আপনার নামে লিখে দেব।”
উমেদার রানা সম্পর্কে জানতে ধানমন্ডির সাব রেজিস্ট্রার আবুল হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে “ স্যার ব্যস্ত আছেন, পরে আসেন” - এই কথা বলে ভেতরে প্রবেশে বাধা দেন রানা আহমেদ। পরবর্তীতে আবুল হোসেনের মোবাইলে ফোন দিলেও তিনি কলটি রিসিভ করেন নি।
উল্লেখ্য, ঘুষের বিনিময়ে জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন, ভূমি হস্তান্তরে দলিল নিবন্ধনে ঘুষ বা অতিরিক্ত টাকা আদায়, জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত মোহরার, এক্সট্রা মোহরার ও উমেদারদের মধ্যে ৩৮জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শনাক্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই দিন তাৎক্ষণিকভাবে জেলা রেজিস্ট্রার অফিস থেকে ওই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির ব্যক্তিগত ফাইল থেকে তাদের যোগদান, পদোন্নতি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করেন টিমের সদস্যরা। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে থাকা অর্থ-সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন আকারে দুদকে পাঠাতে জেলা রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের সঙ্গে রেকর্ডরুম সম্প্রসারণসংক্রান্ত কাগজপত্র এবং রেকর্ড কিপারদের সর্বশেষ বদলির তথ্য দুদকে জমা দিতে বলা হয়। ইতোমধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ওই কর্মকর্তাদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করে কমিশনে দাখিল করা হয়েছে। ওই তালিকায় ধানমন্ডির উমেদার রানা আহমেদের নামও রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তার মুঠোফোনে কল দিলে নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)