বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ‘নো ওয়ার্ক, নো পেমেন্ট’ পদ্ধতিতে চাকরি করা এক্সট্রা মোহরার বা নকল-নবিশরা পাতা প্রতি পান মাত্র ২৪ টাকা। সারাদেশে এমন নকল নবিশের সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। সে হিসেবে একজন নকল নবিশের মাসে আয় ১৫/২০ কিংবা ২৫ হাজার টাকার বেশি নয়। বর্তমান বাজারে এই সামান্য টাকায় পরিবার নিয়ে দু’বেলা ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাই দায়। অথচ, বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাটসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নকল নবিশ আতাউর রহমান। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি দুদকে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন জনৈক ভুক্তভোগী।
গত ২৫ মার্চ দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগ থেকে জানা যায়, ভুয়া নামজারীর মাধ্যমে দলিল করা, খাজনা আদায়ের রশিদ ছাড়া দলিল করা, গৃহায়নের সেল পারমিশন বহিভূর্ত ফ্ল্যাটের দলিল করা, দলিলে ফিস দাগানোর নামে অবৈধ আয়ের টাকায় আতাউরের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় বিভিন্ন দাগে ৮ বিঘা জমি কিনেছেন। রাজধানীর মিরপুরে ৬০ ফিট রোডের পাশে ৫ কাঠার একটি প্লট, ক্যান্টনমেন্ট মানিকদি বাইগারটেকে একটি ফ্ল্যাট। সাভারের আকরান বাজার ভাগ্নি বাড়ীতে টিনশেড বিল্ডিংসহ ১২ কাঠা জায়গা কিনেছেন। এছাড়াও তিনি ২০২৩ সালের ৩০ মে রামপুরা পূর্ব চৌধুরীপাড়ায় কোটি টাকার ফ্ল্যাট কিনেছেন (দলিল নং-৫৯৫৮) যা খিলগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন সময়ে ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের গোপন তথ্য ফাঁস করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আতাউর রহমান।
অভিযোগ মতে, নিষেধাজ্ঞাকৃত সরকারি কেয়ারি সম্পত্তির রেজিস্ট্রি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নকল নবিশ আতাউর। ২০১৭ সালে ধানমন্ডি অফিসে আসার পর ভ্যাট ও এআইটি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ ছিলো আতাউরের দখলে। এই সুযোগে টানা তিন বছর পে-অর্ডারের টাকা আত্মসাৎ করার পর ২০২০ সালে ধানমন্ডির তখনকার সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা হাতে-নাতে ধরেন আতাউরকে। এ বিষয়ে লিখিত প্রমাণসহ জেলা রেজিস্ট্রার, ঢাকা বরাবর চিঠি প্রেরণ করেন লুৎফর রহমান মোল্লা। পরবর্তিতে জেলা রেজিস্ট্রারকে অঙ্গীকার দিয়ে সমঝোতা করেন আতাউর রহমান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আতাউরের এক সহকর্মী জানান, “নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষ ছিল আতাউর। তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে থাকাকালীন তিনি ভাড়া বাসায় থাকতেন, ঠিকমতে ভাড়াও দিতে পারতেন না। ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যোগদানের পর থেকেই শুনছি আতাউর এখন কোটিপতি। আইএফআইসি ব্যাংকে তার মাস্টার আকাউন্টও আছে। এ যেন জিরো থেকে হিরো বনে যাওয়ার গল্প। ঢাকায় আসার আগে আতাউর তার গ্রামে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষকতা করতেন। অথচ গত কয়েক বছরের ব্যবধানে নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন আতাউর।”
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখা-৭-এর দুই কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন চুক্তির মাধ্যমে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া মীর কাসেম আলীর জমি বেচা-কেনা এবং ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন করেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আতাউর রহমান সিন্ডিকেট। মীর কাসেমের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের (প্লট-১৪৮জি (পুরাতন), ৬০ (নতুন); রোড নং ১৩৮ (পুরাতন), ২এ (নতুন)] ৯ কাঠা ৪ ছটাক জমির ওপর নির্মিত ‘কেয়ারী ক্রিসেন্ট’ নামে ১৩ তলা ভবনের ১২ তলায় ১,০৮৪ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট (এ-১১ ও এ-১২) হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল চক্রটি। ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি সময়ের মধ্যে দুটি ফ্ল্যাটের হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। দাতা হিসেবে কেয়ারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুল হুদা এবং গ্রহীতা হিসেবে খন্দকার হাবিবার নাম উল্লেখ করা হয়। ফ্ল্যাট দুটি হস্তান্তরের আর্থিক মূল্য দেখানো হয় ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। অথচ তখনকার বাজারমূল্য অনুযায়ী ফ্ল্যাট দুটির দাম ২ কোটি টাকার বেশি ছিলো।
এসব বিষয়ে জানতে নকল নবিশ আতাউর রহমানের মুঠোফোন নাম্বারে কল দিলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, “আমার এইসব বিষয়ে কথা বলার জন্য একজন সাংবাদিক ভাই দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনিই আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন। কিছু জানতে চাইলে আপনাকে তার (সাংবাদিকের) সঙ্গেই কথা বলতে হবে। আমি কোন বক্তব্য দিতে পারবো না।”
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)