সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আইপিএল নিলাম থেকে মোস্তাফিজুর রহমানকে দলে টানলো চেন্নাই সুপার কিংস। তখন পর্যন্ত এই ফ্র্যাঞ্চাইজির অধিনায়ক ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা আশায় বুক বাঁধলেন, অধিনায়ক ধোনির ক্ষুরধার মস্তিষ্কে সাফল্য মোড়ানো পারফরম্যান্স পাওয়া যাবে মোস্তাফিজের কাছ থেকে। সমান্তরালে সংশয়ের মেঘও জমাট বাঁধল- অন্য বিদেশিদের ভিড়ে একাদশে জায়গা পাবেন তো বাঁহাতি পেসার?
আশঙ্কার মেঘ সরে যেতে সময় লাগলো না। চেন্নাইয়ের প্রথম ম্যাচের একাদশে মোস্তাফিজ। শুধু মাঠে নামলেন না, অবিশ্বাস্য বোলিংয়ে মুগ্ধতা ছড়ালেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ব্যাটারদের নাকানিচুবানি খাইয়ে ৪ ওভারে ২৯ রান দিয়ে নেন ৪ উইকেট। ব্যস, আর ঠেকায় কে! চেন্নাইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেন মোস্তাফিজ।
এই মোস্তাফিজকে দুই রকম চরিত্রে দেখা যাচ্ছে এবারের আইপিএলে। চেন্নাইয়ের মাঠে তিনি রাজার ভূমিকায়, আর অ্যাওয়েতে বড্ড বিবর্ণ। আইপিএলে চেন্নাইয়ের ঘরের মাঠ এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়াম। এবারের আসর তারা শুরু করেছিল এই মাঠ থেকেই। প্রথম ম্যাচে একাদশে সুযোগ পেয়ে যান বাংলাদেশি পেসার। বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে তিনি যা করলেন, আইপিএল ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনও বোলারের এমন পারফরম্যান্স ছিল না। প্রথম ওভারেই তার জোড়া আঘাত। দ্বিতীয় ওভারেও ২ উইকেট। সব মিলিয়ে ৪ ওভারে ২৯ রান দিয়ে তার শিকার ৪ উইকেট।
আইপিএলে চেন্নাইয়ের পরের ম্যাচও ঘরের মাঠে। প্রথম ম্যাচের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে একাদশে জায়গা পাক্তাপোক্ত করে নিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে এই ম্যাচেও বারুদে বোলিং তার। বাংলাদেশি পেসারের স্লোয়ার-কাটারে কাটা পড়েন গুজরাটের ব্যাটাররা। রাহুল তেওকিয়া ও রশিদ খানকে আউট করে মোস্তাফিজের ৪ ওভারে ৩০ রান দিয়ে ২ উইকেট। সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির স্মারক হিসেবে তার মাথায় বেগুনি ক্যাপ আরও স্থায়ী হয়।
এই মোস্তাফিজ এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের তৃতীয় ম্যাচেও আলো ছড়ান। এবার কলকাতা নাইট রাইডার্সের ব্যাটারদের কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন। তার চমৎকার বোলিংয়ে কলকাতা নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেটে করতে পারে ১৩৭ রান। সফরকারী অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ারের পর মিচেল স্টার্ককে ফেরান কাটার মাস্টার। এখানেও মিতব্যয়ী বোলিংয়ে উজ্জ্বল মোস্তাফিজ। ৪ ওভারে ২২ রান দিয়ে শিকার ২ উইকেট।
অর্থাৎ, চেন্নাইয়ের মাটিতে খেলা প্রথম তিন ম্যাচে ৮১ রান খরচায় মোস্তাফিজ পেয়েছেন ৮ উইকেট। কী দুর্দান্ত তার বোলিং। কিন্তু একই বোলারের অ্যাওয়ে ম্যাচের পরিসংখ্যানে চোখ বুলালে কেবলই হতাশার ছবি ফুটে উঠবে। চেন্নাইয়ের বাইরে গেলেই কেন জানি এলোমেলো হয়ে পড়েন মোস্তাফিজ! বোলিংয়ের ধার হারানোর সঙ্গে উইকেটেও যেন বিরুদ্ধ আচরণ করে তার সঙ্গে।
এবারের আসরে মোস্তাফিজ প্রথম অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলেন বিশাখাপত্তনমে। দিল্লি ক্যাপিটালসের বিপক্ষে এই ম্যাচে একটি উইকেট পেয়েছেন তিনি, তবে ৪ ওভারে খরচ করেন ৪৭ রান। আগের দুই ম্যাচের সঙ্গে যেটি বড্ড বেমানান। এরপর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে অবস্থা আরও খারাপ। এবারের আইপিএলে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান খরচ করেছেন তিনি মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে। ওয়াংখেড়ের ওই ম্যাচে চেন্নাইয়ের সবচেয়ে খরুচে বোলার ছিলেন বাংলাদেশি পেসার। ৪ ওভারে দিয়েছিলেন ৫৫ রান।
লখনউ সুপার জায়ান্টসের মাঠ অটল বিহারী বাজপেয়ী স্টেডিয়ামে গিয়েও ছন্নছাড়া মোস্তাফিজ। বোলিংয়ে তালগোল পাকিয়ে মুক্তহস্তে রান খরচ করেছেন। লখনউয়ের ব্যাটারদের সামনে ৪ ওভারে দেন ৪৩ রান। অর্থাৎ, অ্যাওয়ে ম্যাচে এখন পর্যন্ত খেলা তিন ম্যাচে তার পরিসংখ্যানটা এমন- ১৪৫ রান খরচ করে পেয়েছেন ৩ উইকেট। যেখানে চেন্নাইয়ের মাঠে সমান ম্যাচে ৮১ রান দিয়ে নিয়েছেন ৮ উইকেট।
এখন প্রশ্ন হলো, চেন্নাইয়ের মাঠে দুর্দান্ত পারফর্ম করা মোস্তাফিজ কেন খেই হারাচ্ছেন অ্যাওয়েতে ম্যাচে? একটি কারণ হিসেবে সামনে আসবে ঘরের মাঠের আত্মবিশ্বাস। কিন্তু মোস্তাফিজ তো এই মাঠে প্রথম ম্যাচেই আলো ছড়িয়েছিলেন, যেখানে কিনা চেন্নাইয়ের সঙ্গে আগে কখনও খেলেনওনি তিনি।
ঘরের মাঠের সমর্থন অবশ্যই সবসময় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে মোস্তাফিজের সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো চেন্নাইয়ের কন্ডিশন। এমএ চিদাম্বরমরের উইকেট ভারতের অন্যান্য ভেন্যুর তুলনায় কিছুটা স্লো। অনেকটা মিরপুর স্টেডিয়ামের মতো। সুবিধাজনক কন্ডিশনের ফায়দা তুলে নিয়ে চেন্নাইয়ের মাঠে দাপট দেখাচ্ছেন বাংলাদেশি তারকা।
কিন্তু এই মাঠেও তো শেষ রক্ষা হলো না মোস্তাফিজের। আগের তিন ম্যাচে ব্যাটারদের ওপর ছড়ি ঘোরালেও লখনউয়ের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ‘ভিলেন’ বনে গিয়েছেন তিনি। প্রথম ৩ ওভারে তার বোলিং মন্দ ছিল না। ৩২ রান দিয়ে একটি উইকেটও পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ ওভারে বল হাতে তুলে নিয়ে শুধু নিজে ডোবেননি, ডুবিয়েছেন গোটা দলকে!
শেষ ওভারে জিততে লখনউয়ের দরকার ছিল ১৭ রান। টি-টোয়েন্টি যুগে খুব একটা কঠিন নয়। তবে ঘরের মাঠে মোস্তাফিজের যে পারফরম্যান্স, তাতে কাজটা সহজ ছিল না লখনউয়ের জন্য। কিন্তু বাঁহাতি পেসার এবারের আইপিএলের সম্ভবত সবচেয়ে বাজে বোলিংটা করলেন।
আগের ওভারেই সেঞ্চুরি পাওয়া মার্কাস স্টোইনিস তার ওভারই শুরু করলেন ছক্কা হাঁকিয়ে। পরের বলে আবার বাউন্ডারি। তৃতীয় বলটি মোস্তাফিজ ‘নো’ করলে সেটাও সীমানা ছাড়া করেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটার। এরপর ফ্রি-হিটে চার মেরে জয় নিশ্চিত করেন তিনি। অর্থাৎ, ৬ বলে যেখানে ১৭ রানের প্রয়োজন ছিল, সেটি মাত্র ৩ বলেই পূরণ করে দেন স্টোইনিস। আর ওই ৩ বলে মোস্তাফিজ খরচ করেন ১৯ রান!
যে মাঠে আলো ছড়িয়ে চেন্নাইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন, সেই এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে অসহায় আত্মসমর্পণে মুখ লুকালেন মোস্তাফিজ। নায়ক থেকে ভিলেন হওয়ার মাঝে মাত্র কয়েকটা ম্যাচের ব্যবধান!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)