মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


ব্যাংক খাতে লুটপাট থেমেছে, সংস্কারের নানা উদ্যোগ

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

প্রকাশিত:১ জুন ২০২৫, ১৫:৩০

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ব্যাংক থেকে যেভাবে লুটপাট হয়েছিল, নতুন সরকার গঠনের পর সেই ধারা থেমেছে। যেসব ব্যাংক লুটপাটের শিকার হয় ও অব্যবস্থাপনার মধ্যে ছিল, তার ১৪টির পরিচালনা পর্ষদ বদল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৬টি ব্যাংক এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি; এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে এখনো সমস্যায় পড়ছেন গ্রাহকেরা। সার্বিকভাবে বলা যায়, ব্যাংক খাতের কিছুটা উন্নতি হলে দুর্দশা কাটেনি। ব্যাংক খাত নিয়ে আগের মতো আতঙ্ক নেই।

লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোর ঋণ খারাপ বের হতে শুরু করেছে, তাতে তিন মাসেই (অক্টোবর-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ কারণে পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে খারাপ হয়েছে ব্যাংক খাতের প্রায় সব আর্থিক সূচক। এদিকে গ্রাহক আস্থা কমে আমানতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। রাজনীতিসহ সার্বিক পরিস্থিতির কারণে ঋণের চাহিদাও কম।

সরকার বদলের পর ব্যাংক খাতে তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে। যার অধীন ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তবে কত দিনে এসব কার্যকর হবে ও গ্রাহকেরা নির্বিঘ্নে লেনদেন করতে পারবেন, তা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

কারণ, ব্যাংকগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আবার নামে-বেনামে নেওয়া ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এদিকে অর্থ পাচার রোধে সমন্বয়কের দায়িত্ব থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এখন কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন অর্থ আত্মসাতের জড়িত গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেমন তৎকালীন প্রভাবশালীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেন। অভিযোগ উঠেছে, এখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বিএনপির দুজন নেতা একইভাবে তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চাপ দেওয়া শুরু করেছেন।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক খাতে যে ক্ষত হয়েছে, তা অপূরণীয়। বর্তমান সরকার সেটা থামাতে পেরেছে, এটা বড় অর্জন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিকল্পনাগুলো করছে, এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংকঋণের চাহিদা কম, ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এদিকে মনোযোগ দিতে হবে।’

সংস্কারের যত উদ্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ব্যাংকগুলোয় তদারকি জোরদার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি এত দিন নীতিমালায় যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে। এ ছাড়া আগের সরকারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে। যার অধীন ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ জন্য সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান ও সুবিধাভোগী যাচাইয়ে বিদেশি নিরীক্ষক দিয়ে নিরীক্ষা চলছে। যার মাধ্যমে ৬টি ইসলামি ধারার ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংককে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও দেশি ভালো বিনিয়োগকারী এনে শক্তিশালী করার চিন্তা চলছে। এই ছয় ব্যাংক হলো সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যা শিগগিরই অনুমোদিত হতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার চিন্তা চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা চালু করতে পারছে না। ফলে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে এনে ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো অর্থায়ন এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুনাফা কে মুজেরী বলেন, ‘ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে; পাশাপাশি জড়িত ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। অনেক দিন ধরে নানা ঘোষণা শোনা যাচ্ছে, তবে কার্যকর তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাস্তবে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে এনে ব্যবসায় ঋণ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই কাজের কাজ হবে।’

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যা হয়েছিল

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথম মেয়াদেই সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়। তখন ব্যাংক খাতে দাপট ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের। বেক্সিমকো ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়। তবে তখন ব্যাংক দখল করার ঘটনা শুরু হয়নি। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) এ কে কমার্স, ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংক দখল করে ব্যাপক লুটপাট চালান; পাশাপাশি ওই সব ব্যাংকে ছাপিয়ে টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সময়ে আওয়ামী–সমর্থিত আরও অনেকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেন। বিদায়ী সরকারের সময় খেলাপি ঋণ কম দেখানোর নানা কৌশল নেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা এখন বের হয়ে আসছে। ব্যাংক খাতে এমন ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে।

এদিকে গত ডিসেম্বরেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই ছিল। দেশের ব্যাংক–ব্যবস্থায় গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৩:৪৫ ভোর
যোহর ১১:৫৭ দুপুর
আছর ০৪:৩৬ বিকেল
মাগরিব ০৬:৪৬ সন্ধ্যা
এশা ০৮:০৮ রাত

মঙ্গলবার ৩ জুন ২০২৫