শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
চিত্রনায়িকা পরীমণির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের করা হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) এ মামলার প্রতিবেদন গ্রহণ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার পরিদর্শক মো. মনির হোসেন সম্প্রতি ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে আসামি পরীমণি ও তার কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিমের বিরুদ্ধে বাদীকে মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আরেক আসামি ফাতেমা তুজ জান্নাত বনির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলা হয়েছে।
মামলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী তুহিন সিদ্দিকি অমির সঙ্গে জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিমের পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে মাঝে মধ্যে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ হতো এবং একে অপরের বাসায় আসা যাতায়াত ছিল। ২০২১ সালের ৮ জুন তুহিন সিদ্দিকি অমি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনানী কিংস বেকারি শপে অবস্থানকালে পরীমণির কস্টিউম ডিজাইনার জিম তাকে ম্যাসেঞ্জারে কল করে বনানীর বাসায় যেতে অনুরোধ করেন। বাসায় যাওয়ার পর অমির সঙ্গে পরীমণি এবং ফাতেমা তুজ জান্নাত বনিদের সাক্ষাৎ হয়।
এরপর তারা অমির কাছে জানতে চান এত রাতে উত্তরা ক্লাবে যাওয়া যাবে কি না? উত্তরে অমি জানান, রাত বেশি হচ্ছে তাই এখন উত্তরা ক্লাবে যাওয়া যাবে না। তখন জিমি জানতে চান যে, তাহলে বোট ক্লাবে যাওয়া যাবে কি না? জবাবে ঢাকা বোট ক্লাবে যাওয়া যাবে মর্মে জানান অমি। তখন পরীমণির অনুরোধে অমিসহ তারা চারজন অমির কালো রঙের জিপ গাড়িতে করে রাত ১২টা ২২ মিনিটে ঢাকা বোট ক্লাবে আসেন। গাড়ির পেছনে পরীমণির সাদা রঙের খালি জিপ গাড়ি বোট ক্লাবে প্রবেশ করে।
ক্লাবের দোতলায় উঠে প্রথমে পরীমণি ও ফাতেমা তুজ জান্নাত বনি বারের সামনে থাকা টয়লেট ব্যবহার শেষে বারের ভেতরে প্রবেশ করেন এবং টিভির সামনের টেবিলে বসেন। টেবিলে সাক্ষী অমিও বসেন। সৌজন্যতার খাতিরে অমি তাদেরকে স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার নিজ খরচে পরিবেশন করে আপ্যায়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরীমণি একটি এক লিটারের ব্লু-লেবেল মদের বোতল অর্ডার করেন। পরীমণি ও তার সঙ্গে থাকা জিম ও বনি নিমিষেই সেই বোতলের এ্যালকোহল পান করে বোতল খালি করে ফেলেন এবং অনুরূপ আরেকটি বোতলের অর্ডার করেন। তারা ঐ বোতলের আংশিক মদ পান করেন।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে আড্ডার একপর্যায়ে। সেসময় তাদের ২/৩ টেবিল পেছনে বোট ক্লাবের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নাছির উদ্দিন মাহমুদকে আরো দুজন ব্যক্তির সঙ্গে বসা দেখতে পান অমি। তখন অমি পরীমণিকে নিয়ে নাছির মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং পুনরায় তাদের টেবিলে এসে বসে মদ্যপানসহ গল্পগুজব করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর ড্রিংকস শেষে পরীমণি ওয়েটারকে আরো এক লিটারের তিনটি ব্লু লেবেল মদের বোতলসহ দুই বোতল ওয়াইন পার্সেল দেওয়ার জন্য অর্ডার করেন।
ওয়েটার তখন পরীমণিকে দুই বোতল ওয়াইন পার্সেল দিলেও ব্লু লেবেল মদের বোতল স্টকে না থাকায় পার্সেল দিতে পারেননি। কিন্তু পরীমণি জোর করে ওই বোতল নিতে চান এবং টেবিলে হট্টগোল করতে থাকেন। তখন পরীমণি বনিকে থাপ্পড় মেরে বলে, ‘আমাকে দেখে কি মাতাল মনে হয়?’ পরীমণির সঙ্গে থাকা জিম তাকে শান্ত করতে গেলে তাকেও পরীমণি থাপ্পড় মারেন। একপর্যায়ে পরীমণি খুবই উত্তেজিত হয়ে টেবিলের ওপর থাকা গ্লাস, অ্যাশট্রে, বোতল ফ্লোরে এদিক ওদিক ছুঁড়তে থাকেন। তখন নাছির মাহমুদ ক্লাবের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে পরীমণিকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এতে পরীমণি আরো ক্ষেপে গিয়ে একটি অ্যাশট্রে নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারেন। যা তার ডান কানের ওপরে মাথায় লাগে।
তখন জিম তেড়ে এসে বাদী নাছির মাহমুদকে গালমন্দ করতে করতে ২/৩ টা কিলঘুষি মারেন। এরপর আবারও পরীমণি বারের ভেতরে যত্রতত্র গ্লাস ছুড়ে ভাঙচুর করতে থাকেন। একটি গ্লাস নাছির মাহমুদের বুকে লাগলে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। তখন নাছির মাহমুদ বোট ক্লাব ত্যাগ করে চলে যান।
এদিকে ক্লাবে তাদেরর পান করা এবং পার্সেল হিসেবে নেওয়া দুই বোতল ব্লু লেবেলের দাম ও পার্সেলে নেওয়া দুই বোতল ওয়াইনের দাম না মিটিয়ে ক্লাব ত্যাগ করেন পরী ও তার সঙ্গীরা। বোতল চারটির দাম ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এছাড়া ক্লাবের ভেতর ভাঙচুর করায় আনুমানিক ২০ হাজার টাকার মতো ক্ষতি হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার পরিদর্শক মো. মনির হোসেন বলেন, মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর থেকে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করেছি। বাদীর অভিযোগের বিষয়ে নিবিড় তদন্ত করে এ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছি। ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী আছে, মেডিক্যাল রিপোর্ট আছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
২০২১ সালের ৬ জুলাই ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসানের আদালতে বোট ক্লাবের সভাপতি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন। মামলায় পরীমনিসহ তিনজনকে আসামি করা হয়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- পরীমনির সহযোগী ফাতেমা তুজ জান্নাত বনি ও জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিম।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, পরীমনি ও তার সহযোগীরা অ্যালকোহল সেবনে অভ্যস্ত। তারা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন নামিদামি ক্লাবে ঢুকে অ্যালকোহল পান করেন এবং পারসেল নিয়ে মূল্য পরিশোধ করেন না। পরীমনি তার পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে মিথ্যা মামলা করিয়ে হয়রানির ভয় দেখান। ২০২১ সালের ৯ জুন রাত ১২টার পর আসামিরা সাভারের বোট ক্লাবে ঢোকেন এবং দ্বিতীয় তলার ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। পরে তারা ক্লাবের ভেতরে বসে অ্যালকোহল পান করেন।
মামলায় আরও বলা হয়, নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তার সহযোগী শাহ শহিদুল আলম রাত ১টা ১৫ মিনিটে যখন ক্লাব ত্যাগ করছিলেন, তখন পরীমনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাসিরকে ডাক দেন। তাদের সঙ্গে কিছু সময় বসারও অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে পরীমনি অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নাসিরকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন এবং একটি ব্লু লেবেল অ্যালকোহলের বোতল বিনামূল্যে পারসেল দেওয়ার জন্য চাপ দেন। এতে রাজি না হওয়ায় নাসিরকে গালাগাল করেন পরীমনি। নাসির এবং আসামিদের মধ্যে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে পরীমনি বাদীর দিকে একটি সারভিং গ্লাস ছুড়ে মারেন এবং হাতে থাকা মোবাইল ফোন ছুড়ে মারেন। এতে নাসির মাথায় এবং বুকে আঘাত পান।
মামলায় বাদী আরও উল্লেখ করেন, পরীমনি ও তার সহযোগীরা নাসিরকে মারধর ও হত্যার হুমকি দিয়েছেন ও বোট ক্লাবে ভাঙচুর করেন। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে পরীমনি সাভার থানায় নাসিরসহ দুজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে মামলা করেন বলে নাসিরের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)