শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
‘‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারবো না’’; ‘‘আমি আত্মগোপনে আছি, আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে পারি’’; ‘‘আমি নিরাপদ কোনও স্থানে আপনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো’’; ‘‘আপনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে, যে কারণে আমি আপনার সাথে দেখা করতে পারবো কি না জানি না।’’
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও পূর্ববর্তী সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট অ্যাকটিভিস্টদের কাছ থেকে এসব বার্তা পেয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। গত এক সপ্তাহ ধরে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক শুভজিত রায় বাংলাদেশের অজ্ঞাত কিছু স্থানে তাদের কয়েকজনের সাথে দেখা করেছেন এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিশোধের ভয়ে আত্মগোপনে থাকা এসব ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন।
তাদের সবাই প্রায় একটি কথা বলেছেন, ‘‘হাসিনা দল ও জনগণকে ত্যাগ করেছেন।’’ আওয়ামী লীগের এক নেতা হাসিনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আপা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
নেতাকর্মীদের রেখে চলে যাওয়ার এই একই অনুভূতি আরও অনেকে শেয়ার করেছেন। যারা ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আগে কোনও আঁচই পাননি। সেই দিন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং তার বোন শেখ রেহানাসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ বর্তমানে ভারতে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলেছে, শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তার মন্ত্রিসভা, এমনকি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও ‘‘একেবারে বিস্মিত’’ করেছে। আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, ‘‘আমরা তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে টেলিভিশন থেকে জানতে পেরেছি।’’
শেখ হাসিনার এভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের জীবনকে বিপদে ফেলেছে এবং বিক্ষুব্ধ জনতা- বিক্ষোভকারী, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং সুযোগসন্ধানীরা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পার্টি অফিসগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে। তারা সেগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ভাঙচুর করছে, লুটপাট করছে।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘‘আমরা ঠিক সময়েই আমাদের বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিলাম, যখন সেনাপ্রধান বিকাল ৩টার দিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন এবং লোকজন টিভি পর্দায় নজর রাখছিল।’’
আরেক নেতা, যিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি বলেন, ‘‘ধরা পড়লে আমার পরিবার ও আমাকে পিটিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো।’’
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধীদলের নেতারা শেখ হাসিনা সরকারের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। তাদের জেলে ভরানো হয়েছে, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে পরিস্থিতি বদলে যায়।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে কেউ কেউ বিশেষ করে জুলাই মাসে ছাত্র ও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো হয় এবং তারপর ৩-৪ আগস্ট যখন লোকজন রাস্তায় নেমে আসেন, তখন দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিক্ষোভকারীরা ৫ আগস্ট, যেদিন সরকার পতন হয়েছিল সেদিন কারফিউ ভাঙেন।
সরকারের পতনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠীকে দায়ী করে একজন নেতা বলেন, ‘‘তিনি (শেখ হাসিনা) আমাদের কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নেতাদের একজন এই গোষ্ঠীকে ‘‘দ্য গ্যাং অব ফোর’’—বলে অভিহিত করেছেন। যারা তাকে (শেখ হাসিনা) মাঠের বাস্তব অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন বলে মন্তব্র করেছেন তিনি।
এই গ্যাং অব ফোর হলেন, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ‘‘এই গ্যাং অব ফোরই তার পতনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর এই চারজনের প্রতি শেখ হাসিনার অন্ধ বিশ্বাস ছিল এবং অতীতে তার যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তা তাদের কারণেই হারিয়েছেন।’’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিএনপিকে নির্বাচনে না আনাকে শেখ হাসিনার ‘‘বড় ভুল’’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। একাধিক সূত্র বলেছে, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা লন্ডনে বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সাথে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন।
একটি সূত্র বলেছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে একটি ব্যাকচ্যানেলের মাধ্যমে প্রস্তাবও করা হয়েছিল। আমরা ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের এক বছর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তারেকের সাথে ওই চ্যানেলটি প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা এই প্রস্তাবে সবুজ সংকেত দেননি।
আওয়ামী লীগের একজন নেতার মতে, বিএনপির প্রধানের ছেলের সাথে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টিতে অস্বীকৃতি জানানোই ছিল শেখ হাসিনার জন্য বড় ভুল। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপিকে প্রস্তুত করা হলে তা বিরোধীদের ক্ষোভ ও অভিযোগকে লাঘব করতো।
ওই নেতা বলেন, ‘‘আমরা দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পুলিশি নির্যাতনের কারণে জনগণের মাঝে তৈরি হওয়া ক্ষোবের বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলাম... এবং নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে বোর্ডে আনা গেলে সেই ক্ষোভ থেমে যেতো। সেটি করা হলে আমরা জিততে পারতাম এবং দলকে ক্ষমতায় রাখতে পারতাম।’’
তিনি বলেন, বিশেষ করে ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর শেখ হাসিনা অনেক বেশি একগুঁয়ে হয়ে ওঠেন এবং কারও পরামর্শে কর্ণপাত করেননি বলে নেতাকর্মীরা মনে করেন। টানা চতুর্থ জয়ের পর তিনি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং কোটা সংস্কার ঘিরে শুরু হওয়া প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জনগনের ক্ষোভের মাত্রা বুঝতে ব্যর্থ হন তিনি।
সূত্রগুলো বলেছে, জুলাইয়ের শুরুতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সাথে বসার জন্য কৌশলে কিছু নেতা শেখ হাসিনাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার জুলাই মাসে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের তুলে নিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা শেখ হাসিনার সরকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।
এই কৌশল হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায় এবং কীভাবে জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছিল শিক্ষার্থীরা তা প্রকাশ করেন। এর পরপরই কিছু ঘটনা ঘটে, যার ফলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। প্রাণের ভয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবী দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নেন।
এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জানায়, ২৬ জন রাজনীতিক নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ৬২৬ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতারা ছাড়াও ৫ জন বিচারক, বেসামরিক প্রশাসনের ১৯ কর্মকর্তা, পুলিশের ২৮ কর্মকর্তা, বিভিন্ন পদের ৪৮৭ জন পুলিশ সদস্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার ১২ জন এবং ৫১টি পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ কয়েকজন মন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সময় ধরা পড়েছেন। এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বিদেশ যাওয়ার সময় আটক হয়েছেন।
হাসিনা চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা আত্মগোপনে গেছেন এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলের নেতারা বলেছেন, সাড়ে ১৫ বছর ধরে দেশ শাসন করা ৫০ বছর বয়সী দলটি এখন অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
ভবিষ্যতের প্রথম পদক্ষেপ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, ‘‘দল পুনর্গঠনের জন্য তার (হাসিনা) উচিত হবে তৃণমূলের লোকজনকে বাছাই করা, কিছু তরুণ আওয়ামী নেতা; যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, জনগণের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এবং অবশ্যই পরিবারের (শেখ হাসিনার) প্রতি আনুগত্য রয়েছে... এটি দীর্ঘ পথ হতে যাচ্ছে।’’
আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে এখন যেসব মামলা ও অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে, এসব মামলার দীর্ঘ প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, অন্তত একজন সাধারণ সম্পাদক বা একজন পদাধিকারী নির্ধারণ করতে হবে; যিনি আওয়ামী লীগের ব্যানারে সরকারের কাছে পিটিশন লিখতে পারেন। যদি গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মীদের আইনগত অধিকার চাইতে হয়, তাহলে এটি করতে হবে। তবে এই মুহূর্তে কাউকে এমন পদের জন্য মনোনীত করা হয়নি বলে জানান তিনি।
খালেদা জিয়া কারাগারে এবং তারেক রহমান লন্ডনে থাকাকালীন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বাধীন বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ‘‘আমাদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি এবং মানুষের নেটওয়ার্ক ছিল। অনেকে দলত্যাগ করেছেন, যেমন কিছু সুবিধাবাদীরা এটি করছেন। সমর্থকদেরও মাঝেও এমন লোকজন থাকবেই। তবে আমাদের অন্তত এমন কেউ একজন বা একদল লোক থাকা উচিত যারা অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে যুক্ত হতে পারেন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এটি সময়ের প্রয়োজন।’’
রাজপথে জনসাধারণের মনোভাব শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বিরোধী হলেও আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, হাসিনা পরিবার ও তার উত্তরাধিকারী সজীব ওয়াজেদ জয়ের ন্যূনতম বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘‘লোকজন এখনও ক্ষুব্ধ...তাদের সময় দিতে হবে। ক্ষমতায় থাকা কয়েকটি বছর তা অন্তর্বর্তী সরকার কিংবা বিএনপি বা জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ভবিষ্যৎ সরকার হোক না কেন, আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু আমাদের দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের পুনর্গঠন ও সংগঠিত করার কথা ভাবতে হবে।’’
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)