শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আজ বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় বঙ্গভবনে শপথ নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে এ সরকারের মেয়াদ আসলে কতদিন হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যমান সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো রূপরেখা নেই। ফলে সংবিধানের বাইরে গিয়ে এ সরকার গঠন করতে হবে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা গত বুধবার রাতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও কাদের নিয়ে সরকার গঠন হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেন। ওই বৈঠকে এ সরকারের মেয়াদ কমপক্ষে তিন বছর হওয়ার বিষয়ে তারা মত দেন। তবে গতকাল ঢাকায় বিএনপির সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনলাইনে দেওয়া বক্তব্যে দ্রুত সময়ের মধ্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের তাগিদ দিয়েছেন।
সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্বের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থাকে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সোমবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় বলে মত দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে সাধারণ নির্বাচনের পর গঠিত সংসদে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়সীমা তারা নিজেরাই নির্ধারণ করবে।
এদিকে গতকাল বুধবার সেনা সদরে সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য সংখ্যা হতে পারে ১৫-এর মতো। দু-একজন বেশিও হতে পারেন। তিনি বলেন, ড. ইউনূসকে সশস্ত্র বাহিনী সব ধরনের সহায়তা দেবে।
ঢাকায় ইউনূস সেন্টার জানিয়েছে, ড. ইউনূস বৃহস্পতিবার দুবাই থেকে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। এদিকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘সরকারের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আমাদের শান্ত থাকতে হবে। নতুন নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ তৈরি এবং নতুন নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার।’
রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবে ছাত্রদের অসম্মতি
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত সোমবার রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের কাছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ওই দিন দুপুরে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাপ্রধান এবং তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিএনপি-জামায়াতের দলীয় সূত্র জানায়, বঙ্গভবনে সেনাপ্রধানের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিকে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির নেতারা। এই প্রস্তাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিনিধি রাখার কথাও বলা হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপতি তখন এই প্রস্তাব নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার পরে সিদ্ধান্তের কথা জানান। ছাত্র প্রতিনিধিরা এ প্রস্তাবে রাজি হননি।
পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন দলের মনোনীত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্দলীয় সরকার গঠন এবং ৬ মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবও নাকচ করে দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ও মেয়াদ নিয়ে ধোঁয়াশা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা এক্সট্রা অর্ডিনারি সিচুয়েশনে সরকার গঠন করছি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক রীতি অনুসরণ করা হবে। সরকারের মেয়াদ এখনও ঠিক করা হয়নি। এটি আলোচনা চলছে। ছাত্রদের প্রস্তাবক্রমে ড. ইউনূস আসার পর এটি চূড়ান্ত করা হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এখন তো গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। তাই অভ্যুত্থানে যারা আসবেন, তারা যেভাবে বলবেন, সেভাবে করা যাবে। তবে পরবর্তী সংসদে বিষয়টি অনুমোদন করতে হবে।’
এদিকে ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, এর আগে ২০০৭ সালে এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব পেলেও তিনি ফিরিয়ে দেন। কারণ তিনি মনে করেন, কম সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়ে সরকার ব্যবস্থায় গুণগত কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই এবার বেশি সময় না পেলে ড. ইউনূসের দায়িত্ব নেওয়ার কথা নয়। তিনি ঢাকায় না ফেরা পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি। তবে সে সময় তিনি সেনাবাহিনীকে বলেছিলেন, তাঁর দেশ পরিচালনায় তারা হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তাতে সেনাবাহিনী রাজি না হওয়ায় তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি হননি।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল বলেন, সংসদ বিলুপ্তির পর রাষ্ট্রপতিই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। নির্বাহী ক্ষমতাবলেই তিনি নতুন উপদেষ্টা পরিষদের মেয়াদ বেঁধে দিতে পারেন অথবা সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন।
তিনি বলেন, ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গুণগত পরিবর্তন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য না আনলে বর্তমান পরিস্থিতি আবারও আসতে পারে। সে জন্য দরকার হবে নির্বাচিত সংসদ। সংসদের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
আইনজীবী ফিদা কামাল বলেন, ড. ইউনূস একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয় কিছু পরিকল্পনা নিয়েই দায়িত্ব নেবেন। তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটা আগে দেখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নতুন সরকারের প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি কাজগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন, সেটা কমাতে হবে। আবার পার্লামেন্টে কোনো এমপি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হওয়ার বিধান (৭০ অনুচ্ছেদ) পরিবর্তন করতে হবে। দলের কোনো সিদ্ধান্তে কোনো এমপি একমত নাও হতে পারেন। ফলে তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। এমন অনেক কিছুই করতে হবে, যা এই অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো পারবে না; পরবর্তী সংসদে এগুলো করতে হবে।
রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দেওয়ার বিষয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দ্রুত নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে আসছে। তবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে এ মুহূর্তে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। পুলিশসহ অন্য বিভাগগুলো গড়তে কাজ করতে হবে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ছে। এগুলো গড়ে তুলতে অবশ্যই সময় প্রয়োজন। রাজনৈতিক সরকারের হাতে এসব কাজ ছেড়ে দিলে কোনোটাই বাস্তবায়িত হবে না। তিনি বলেন, রাষ্ট্র মেরামতের যে দাবি ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে উঠেছে, তা বাস্তবায়নে সাংবিধানিক কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। সে জন্য দরকার হবে নির্বাচিত সংসদ।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দু’বার বিজয় ছিনতাই হয়ে গেছে। একাত্তরে একবার, আর নব্বই সালে একবার। আমরা পথ হারানো জাতি। এবার এমন কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে এমন আপদ ভবিষ্যতে আর জাতির কাঁধে চেপে বসতে না পারে। অন্যথায় এত মানুষের প্রাণহানি আর ছাত্রদের আন্দোলন পণ্ডশ্রম হয়ে যাবে।
গত মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত হয়। শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে ১৭ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ছাত্রদের প্রস্তাবে উপদেষ্টার তালিকায় আছেন যারা
মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তবে চূড়ান্ত না হওয়ায় তা প্রকাশ করেননি তারা। সূত্র জানিয়েছে, ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। সমন্বয়কদের নিজেদেরও একটি তালিকা আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আরও কয়েকটি তালিকা এসেছে। ড. ইউনূস দেশে ফিরলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবিত তালিকায় আছেন– ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আলী ইমাম মজুমদার, ড. শাহ্দীন মালিক, ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, মো. তৌহিদ হোসেন, শহীদুল্লাহ খান বাদল, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন বলে জানা গেছে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)