বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১
আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের অধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদন করে। সেই থেকে সারা বিশ্বে ১৮ ডিসেম্বর সরকারি, বেসরকারি মহল, অভিবাসীদের সংগঠন নতুন উদ্যমে অভিবাসী অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করে।
বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সব জাতি, বর্ণ, ধর্ম, ভাষার নারী ও পুরুষ অভিবাসীদের অস্তিত্ব, অধিকার, অবদান স্বীকার ও পালনের মধ্য দিয়ে এই দিবসের তাৎপর্য বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো—অভিবাসীদের অবদান ও অধিকারকে সম্মান করা।
বাংলাদেশেও সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠন এই দিবসটি পালন করছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালন করছে। একই সাথে বিগত কয়েক বছর ধরে জাতীয় প্রবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে ৩০ ডিসেম্বর। এই দুইটি দিবসের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকারিভাবে প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে—প্রবাসীর অধিকার, আমাদের অঙ্গিকার; বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, আমাদের সবার।
অভিবাসী অধিকার রক্ষার সংকট ও সমাধান নানা মুখী। সুষ্ঠু, নিরাপদ, সম্মানজনক অভিবাসনের জন্য বছরব্যাপী এবং বছরের পর বছর কর্ম পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন দরকার। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে সেসব কর্মকাণ্ডে অভিবাসী অধিকার অর্জনে অগ্রগতি কত দূর, সেটা মিলিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে।
বাংলাদেশ সরকার, বেসরকারি সংগঠন, রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্রেড ইউনিয়ন—সবারই বিভিন্ন পদক্ষেপ চলমান। তবে প্রয়োজন ও আশার তুলনায় অগ্রগতি যথেষ্ট নয়, তাই অনেকদিন ধরেই একই ধরনের সংকট ও পরামর্শ দেখা যায়। বিশেষ করে নারী অভিবাসনের প্রক্রিয়া ও সুফলের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ যেমন জটিল, তেমনি সমাধানের অগ্রগতিও সামগ্রিক বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে কম।
অভিবাসন প্রক্রিয়ায় নারীদের যে বিশেষ সংকট ও সেজন্য করণীয় নিয়ে বর্তমান আলোচনার একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা রোধে ১৬ দিনের সচেতনতা। এছাড়া ২৫ নভেম্বর নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ এবং ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। ২০২৪ সালে ১৬ দিনের সচেতনতার জন্য মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছিল—নারী, কিশোরী ও কন্যা শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসের জন্য তাই নারী অভিবাসনের বর্তমান অবস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী অভিবাসী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। জর্ডান ও ওমানে গৃহকর্মের পাশাপাশি পোশাক শিল্পেও বাংলাদেশি নারী অভিবাসী কর্মী আছেন। এছাড়া লেবানন ও লিবিয়াতে হাসপাতালে নার্সিং সেবাতেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য নারী অভিবাসী কাজ করেন, তবে আভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং যুদ্ধাবস্থার কারণে এই দুই দেশে নারী অভিবাসীসহ সব অভিবাসী কর্মীদের জন্যই থাকা ও কাজ করা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। অনেকে দেশে ফিরে এসেছেন বা আসার চেষ্টা করছেন, যদিও দেশেও বিভিন্ন কারণে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
নারী অভিবাসন ক্ষেত্রে অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে, নারী অভিবাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনা খরচে অভিবাসন নিশ্চিত করা। যদিও তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি, তবুও পুরুষ অভিবাসনের উচ্চ ব্যয়ের চেয়ে অনেকাংশে কম। এছাড়া গৃহকর্মী হিসেবে অভিবাসন প্রত্যাশী নারী অভিবাসীদের জন্য মাসব্যাপী সরকারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। গৃহকর্মী অভিবাসীদের জন্য একটি মডেল চুক্তিপত্র চূড়ান্ত করা যায় কিনা, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ মিলে সেই চেষ্টা চলছে।
নারী ও পুরুষ অভিবাসীদের বেতনের তারতম্য থাকলেও দেখা গেছে পুরুষ কর্মীদের চেয়ে নারী কর্মী আনুপাতিক হারে প্রবাসে বেশি সঞ্চয় করেন। সফল নারী অভিবাসী দেশে ফিরে পরিবারের আর্থ সামাজিক অবস্থানের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেছেন, অভিবাসন প্রবণ অঞ্চলে এ রকম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। এমনও আছে, কেউ কেউ ছোট আকারে উদ্যোক্তা হয়ে নিজের ও অন্য নারীদের সামাজিক অবস্থান সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন।
সংকট ও সমাধানের আলোচনার আগে একটু দেখা যাক, নারী অভিবাসী সম্পর্কে পরিসংখ্যান কী বলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশে নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান (বরং পুরুষের চেয়ে নারী একটু বেশি), কিন্তু কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন (বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব মতে ৩২ শতাংশ)। তাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক কাজে জীবিকা নির্বাহ করেন। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান আরও বলে যে কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ৫০ শতাংশের বেশি নারী।
তবে দেশের নারী অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারী অভিবাসীরা বেশ পিছিয়ে আছেন। বিশ্বে নারী অভিবাসী ৪১ শতাংশের বেশি হলেও বাংলাদেশের নারী অভিবাসীর সংখ্যা ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। এবার ২০২৪ সালে তা কমে ৫-৬ শতাংশ হয়েছে। ১৯৯০ সালে নারী অভিবাসনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বেশিরভাগ বাংলাদেশি নারী অভিবাসী গৃহাভ্যন্তরে কায়িক শ্রমে নিয়োজিত।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ৭৪ শতাংশ নারী অভিবাসী গৃহকর্ম এবং অনানুষ্ঠানিক পেশায় নিয়োজিত। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশে পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে গৃহসেবা ছাড়া আর কিছুর যোগ্য বিবেচনা করা হয় না। বেতনও পুরুষ কর্মীদের চেয়ে কম। আমাদের অভিবাসী প্রত্যাশী নারীরাও হীনমন্যতায় ভোগেন এবং বৈষম্যমূলক আচরণ মেনে নেন।
আরেকটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী অভিবাসী স্বল্প শিক্ষিত বা লেখাপড়া জানেন না। কাজেই তাদের পাসপোর্ট, অভিবাসন ছাড়পত্র, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের চুক্তিসহ অভিবাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল ও তথ্যসম্ভার নারী অভিবাসীরা পড়তে পারেন না এবং বিস্তারিত জানেন না যে এইসব দলিল অনুযায়ী তাদের অধিকার ও দায়িত্ব আসলে কী।
প্রবাসের জন্য যে প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়। যেমন সৌদি আরবে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সেখানের কাজের ধরন, সামাজিক রীতি-নীতি, মনিব-ভৃত্য সম্পর্ক, খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া—এসব ব্যাপারে কোনো ধারণা নারী অভিবাসীদের তৈরি হয় না। ফলে প্রবাসে গিয়ে এই সবগুলো ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন।
একজন অভিবাসী প্রত্যাশী নারী তার আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণেই অভিবাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরিবারে যদি কর্মক্ষম পুরুষের আয় স্বাভাবিক জীবনমান রক্ষায় যথেষ্ট না হয়, তবে পরিবার থেকেই নারীর ওপর অভিবাসনের চাপ আসে। নারী নিজেও পরিবারকে সহায়তা করার নিমিত্তে অভিবাসন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কোনো ক্ষেত্রেই নারীর এই সিদ্ধান্ত শখে বা শুধু নিজের সুখের জন্য নয়।
অন্যদিকে নারীর গৃহকর্মকে তার পরিবার সম্মানজনক পেশা হিসেবেও মনে করে না, শুধু টাকার মেশিন হিসেবে গণ্য করে পেশাটি কোনো এক রকমে মেনে নেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কষ্টার্জিত আয় নিজ সিদ্ধান্তে দেশে ব্যয় করতে দেয় না পরিবার। কোনো কারণে মেশিন বন্ধ হয়ে গেলে নারী অভিবাসী তার পরিবার-পরিজনের কাছে মর্যাদাহীন হয়ে পড়ে। সমাজও তাকে ভালো চোখে দেখে না। সফল ও বিফল, উভয় ক্ষেত্রেই নারী অভিবাসী দেশে ফেরত আসার পর প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতাকে তাই লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন।
নারী অভিবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় এনজিওবৃন্দ অভিবাসনপ্রবণ এলাকাভিত্তিক সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি। মানুষের মনের পরিবর্তন আনতে অনেক সময় এক প্রজন্ম লেগে যায়। নারী অভিবাসীদের অধিকার ও সম্মানের ব্যাপারে সচেতনতার কাজ সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদে দেশব্যাপী চলমান রাখতে হবে। সেই কাজে তারা এনজিওদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু এনজিওরা অনুদানের ভিত্তিতে ৩ থেকে ৫ বছরের কার্যক্রম চালাতে পারে তাও স্বল্প পরিসরে। তাই দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতামূলক কার্যক্রমের জন্য সরকারি অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনাই উত্তম।
তবে নারী অভিবাসনের ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন দরকার তা হচ্ছে, অভিবাসী প্রত্যাশী নারীদের নিজেদের সচেতনতা, শিক্ষা, দক্ষতা এবং প্রবাস জীবনযুদ্ধ মোকাবিলার কৌশলজ্ঞান বৃদ্ধি। প্রবাসে যাওয়ার জন্য যোগ্যতা হিসেবে বাংলাদেশের নারী শিক্ষার হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ নির্ধারণ করা উচিত। একই সাথে যুগোপযোগী বিভিন্ন কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা এবং প্রবাসে বাংলাদেশি সম্পর্কে শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ের শেষ দুই বছর এবং উচ্চ মাধ্যমিকের দুই বছর দেশের সব ছেলেমেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত।
তবে কোনো কোনো কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিষয় নির্ধারণ ঐচ্ছিক হতে পারে। ইংরেজি শিক্ষার মান প্রাথমিক পর্যায় থেকেই অনেক উন্নত করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর যেকোনো একটি কারিগরি বিষয়ে ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্যেও অভিবাসন সংক্রান্ত ডিপ্লোমা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা এবং যেকোনো আগ্রাসন থেকে মুক্ত থাকার জন্য আত্মরক্ষার বিশেষ পাঠদান থাকা উচিত।
এইসব শিক্ষাক্রম তৈরি ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশি (শ্রমিক ও পেশাজীবী) এবং দেশে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষাদান পদ্ধতি আধুনিক, প্রাণবন্ত এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা-ছাত্রছাত্রীর সমন্বিত প্রয়াসে হতে হবে। সেজন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের আধুনিকায়নও প্রয়োজন।
কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক কেন করতে হবে, অভিবাসী প্রত্যাশীদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের মান উন্নত করলেই তো হয়। সবার জন্য বাধ্যতামূলক করার যুক্তি হচ্ছে, কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা দানের মধ্যে শ্রেণি বিভাজন রয়েছে। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তরা মনে করেন কারিগরি শিক্ষা তাদের সন্তানদের জন্য নয়। আবার নিম্নবিত্তরা মনে করেন, প্রযুক্তি ও ইংরেজি শিক্ষা তাদের সন্তানদের জন্য নয়।
উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ছেলেমেয়েদের হাতের কাজের পাশাপাশি প্রযুক্তি শিক্ষা এবং মাতৃভাষার বাইরে অন্য আরেকটি ভাষায় পারদর্শী করে তোলা হয়। সেসব সন্তানেরা নিজের দেশে ও অন্যত্র ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকে এই ধরনের শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীকে দেশে ও প্রবাসে, সবখানে কাজ করার জন্যই দক্ষ করে তুলবে। আর অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে যে বিভিন্ন সামাজিক স্তরে দূরত্ব রয়েছে, সেটিও কমে আসতে পারে।
নারীর জন্য কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষা এবং অভিবাসনের জন্য ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক হলে নারী অভিবাসন প্রত্যাশীরা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মের জন্য নিজেদের উপযোগী ভাববেন না। বিভিন্নমুখী শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে তারা এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, এমনকি আফ্রিকা ও ইউরোপের জন্যও নিজেদের প্রস্তুত করে তুলতে পারবেন।
স্বাবলম্বী ছাত্রীরা অভিবাসন বয়স (২৫ বছর) থেকে নিজের পাসপোর্ট নিজে আবেদন করতে পারবেন, অনলাইনে বিভিন্ন দেশ ও কাজ সম্পর্কে জেনে নিজেকে আরও প্রস্তুত করতে পারবেন, মাধ্যম নয় সরাসরি নিজে সৎ রিক্রুটিং এজেন্সির খোঁজ করে নিজে বাছাই করতে পারবেন, অনলাইনে এবং কাগজে প্রবাসে কাজের চুক্তিপত্র নিজে পড়ে, বুঝে সম্মতি দিতে পারবেন।
পাশাপাশি বাছাইকৃত দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আরও প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য স্বশিক্ষার উপকরণ বা অ্যাপ-এরও প্রশিক্ষণ থাকা দরকার। ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণে ইমারসিভ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারী অভিবাসীদের সৌদি আরবের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের ভেতরের ভার্চুয়াল রিয়ালিটির অভিজ্ঞতা দিতে পারলে তারা অনেকটা উপকৃত হবেন। এসব নানামুখী প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নারী অভিবাসীরা প্রবাসে নিজের অধিকার আদায়ে যেমন ভূমিকা রাখতে পারবেন, সচেতন থেকে নিজের কর্মদায়িত্বও সুচারুরূপে পালন করতে পারবেন।
ভবিষ্যতে গৃহকর্ম ছাড়াও অন্যান্য পেশায় কাজ করার জন্য তারা দক্ষ হয়ে উঠবেন। বাসাবাড়িতে কাজ না করে কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় কাজ করলে তাদের মানসিক-শারীরিক নিপীড়নের সম্ভাবনা কমিয়ে নিয়ে আসা যায়। তাছাড়া আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ এবং আইনি সহায়তা নেওয়ার প্রক্রিয়া জানা থাকলে যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা নারী অভিবাসী স্ব উদ্যোগে মোকাবিলা করতে পারবেন। দেশে পরিবার ও সমাজ বিভিন্ন পেশার অভিবাসী নারীকে সম্মান করতে শিখবে (তবে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই)।
এ হচ্ছে নারী অভিবাসন সুন্দর অভিজ্ঞতা হিসেবে গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব। নতুন কিছু নয়, অবাস্তব বা অসম্ভবও নয়। তবে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বর্তমান নারী অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা সুন্দর করে তুলতেও নতুন কিছু পদক্ষেপ দরকার। অভিবাসন সংক্রান্ত আইন, নীতিমালা, বিধান ও কর্মকর্তাবৃন্দ সবসময় নারীবান্ধব নন।
একসময় মহিলা (নারী) ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ হয়েছিল। এ ধরনের প্রশিক্ষণ চলমান রাখা দরকার। তাতে করে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সংস্কার, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে নারী সংবেদনশীলতা বাড়বে।
বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত গৃহকর্মীরা কীভাবে তাদের চুক্তি অনুযায়ী বেতন ও ন্যায্য অধিকার পেতে পারে, নিপীড়নের জন্য আত্মরক্ষা করতে পারে, নিপীড়িত হলে আইনি সহায়তা পেতে পারে, প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা এবং দেশে ফিরে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে, স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়াতে পারে—প্রয়োজনের তুলনায় এসব সেবা ও পরামর্শের ব্যবস্থা অপ্রতুল।
এসব ব্যবস্থা সহজ নয় আবার অসম্ভবও নয় তবে অবশ্য প্রয়োজনীয়। কাজের সুবাদে অনেক ফেরত আসা নারী অভিবাসীর সাথে আমি আলাপ করেছি। সবাই অবলা নন, অনেকেই আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী। আবার কারও প্রবাসে নিপীড়ন এত কদর্য যে শুনলেও মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকে না, সেই নারীদের সেই কদর্য স্মৃতি আর শরীরের চিহ্ন বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন।
শুধু তাই নয়, বলপূর্বক নিপীড়নের শিকার ফেরত আসার পর নারী অভিবাসী পরিবারের ও এলাকাবাসীর কাছেও বিড়ম্বনার শিকার হন। এমনকি নিপীড়িত না হলেও সমাজ সন্দেহ করে যে নারী অভিবাসীর চরিত্র ঠিক আছ কি না, যা নারী অভিবাসীদের প্রতি অসম্মানজনক। এই সামাজিক অনিয়ম দূর করতে সরকার, স্থানীয় সরকার, সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
অভিবাসন ক্ষেত্রে অনেক কিছুই করণীয় আছে, কিন্তু নারী অভিবাসনের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য আর দেরি করা চলে না। এখনো তারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। বৈষম্যহীন সবার বাংলাদেশে সব অভিবাসীর অধিকার নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে নারী অভিবাসীদের অধিকারও নিশ্চিত করার সম্মিলিত প্রয়াস থাকবে, আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে এই শুভ কামনা রইলো।
লেখকঃ অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)