সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৪ ভাদ্র ১৪৩২


বদরুদ্দীন উমর প্রতিক্ষণে, প্রতিপদে, থাকবেন সঙ্গে

মুহাম্মদ কাইউম

প্রকাশিত:৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪০

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

ছয় দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের লক্ষকোটি দরিদ্র ও নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া এবং সব পরিস্থিতিতে ক্রমাগত সরব থাকা দৃপ্তকণ্ঠ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সকাল ১০টায় নিস্তব্ধ হয়ে গেল! অত্যন্ত পরিণত বয়সে হলেও এমন ক্রান্তিলগ্নে তার এই চলে যাওয়া যখন তার শানিত যুক্তি, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দিকনির্দেশনা আমাদের দেশ ও সমাজের জন্য বড্ড বেশি প্রয়োজনীয় ছিল!

প্রায় ৯৪ বছর বয়সী ক্ষ্যাপা এই তরুণ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বলে গেছেন স্পষ্ট উচ্চারণে। কোনো ভয়ভীতি, পদ, পদক, পুরস্কারের মোহ কিংবা অর্থবিত্তের হাতছানি নয়, কেবলই এদেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ইতিহাসকে নিবিষ্টভাবে পাঠ করে সূত্রায়িত করে গেছেন দার্শনিক গভীরতা আর সমাজবিজ্ঞানীর প্রায়োগিক ক্ষমতা দিয়ে।

একটা কথা তিনি বারবার বলতেন, ‘শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ ভিন্ন আমাদের কোনো স্বার্থ নেই’! তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, লেখা, গবেষণার বিষয়বস্তু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, কেবল লেখার জন্য লেখা নয়, গবেষণার জন্য গবেষণা নয়, শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যেই তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।

অথচ গণমাধ্যম থেকে ব্যক্তি পর্যায়েও উনাকে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়! কিন্তু বদরুদ্দীন উমর প্রথাগত অর্থে বুদ্ধিজীবী ছিলেন না, গ্রামগঞ্জে মাইলের পর মাইল হেঁটে মাঠে কাজ করা কৃষক, আর কারখানার শ্রমিকের সাথে মিশে ‘বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ’ অত্যন্ত সৃষ্টিশীল পদ্ধতিতে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি লেখালিখি ছাড়াও সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। পূর্ণকালীন রাজনীতি করার জন্য ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেন। অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে উত্তরাধিকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে তিনি পেয়েছিলেন তার সব দুর্বলতা বিশেষ করে তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা দূর করে সঠিকভাবে একটি বিপ্লবী পার্টি গঠনের প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।

১৯৭২ সাল থেকেই তিনি এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সাল থেকে দেশে আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ ও সরকারের দমনপীড়ন হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চিন্তা থেকে ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৯৭৬ সালে কমিউনিস্ট ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বিশেষ কংগ্রেস সংগঠিত করেন এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী), গণ বিপ্লবী পার্টি ও কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ—এই তিনটি দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) গঠন করেন।

গণমানুষের মধ্যে পার্টির কর্মকাণ্ড বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে তিনি গণসংগঠন গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় ১৯৭৯ সাল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে কাজের জন্য বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, কলকাখানা শ্রমিক ছাড়াও নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিক ও অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন এবং ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের মধ্যে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ লেখক শিবির সংগঠিত করার কাজে ব্যাপকভাবে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপ সম্মিলিতভাবে কাজ করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট গঠনে নেতৃত্ব দেন। ২০০৩ সালে কমিউনিস্ট কর্মী, দল ও সমাজের সব সংগ্রামী শক্তির সহায়তায় শোষণমূলক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ অবসান ঘটাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার লক্ষ্যে একটি কনভেনশনের আয়োজন করেন।

কনভেনশনের মাধ্যমে এক মৌলিক রণনীতিগত ১৮ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন এবং সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল গঠন করে এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে ‘ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটি’ গঠন এবং এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১১ সালে ‘জাতিসত্তা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে নেতৃত্ব দেন।

কাজেই, তিনি কেবল একজন লেখক বা বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তাত্ত্বিক এবং কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে এদেশের সাধারণ মানুষকে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম সংগঠিত করার জন্য দীর্ঘ ছয় দশকের আপসহীন লেখালেখি, গবেষণা ও নিরলস বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই বদরুদ্দীন উমরের মূল লক্ষ্য ছিল। তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও বিশ্লেষণমূলক রচনাসম্ভার এদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার অপরিহার্য সোপান হয়ে থাকবে।

সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষিতে আরকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ না করলে তার পূর্ণ মর্যাদা আমরা দিতে পারব না। আমরা সবাই জানি স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের বিপ্লবী রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ছোট ছোট দল বা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নানা ধরনের তত্ত্বের চর্চা এবং সূত্রায়ন করছিল।

এর মধ্যে প্রধান হলো বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র কী! এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন কারণ উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্রের ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে এবং তার প্রেক্ষিতে বিপ্লবের ধরন কী হবে!

সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা হলে একরকম, আধা পুঁজিবাদী আধা সামন্ততান্ত্রিক হলে একরকম, আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হলে অন্যরকম। কোনো কোনো দল তো এমন সূত্র উত্থাপন করেছিল যে, চীনে মাও সেতুং যেমন গ্রাম থেকে ঘেরাও করে শহর দখল করেছিল, এখানেই তাই করতে হবে। কেউ কেউ বলেছিলেন লাতিন আমেরিকার গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় লড়াই সংগঠিত না করলে এদেশে বিপ্লব হবে না!

১৯৭২ সাল থেকেই তিনি এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সাল থেকে দেশে আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ ও সরকারের দমনপীড়ন হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চিন্তা থেকে ‘মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
একমাত্র এবং অনন্য বদরুদ্দীন উমর তখন এদেশের ভূ-প্রকৃতি, পরিবার ও সমাজ কাঠামো, এদেশের মানুষের মনমানসিকতা, শত বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন বাংলাদেশ বিপ্লবের ধরণ হবে ‘গণঅভ্যুত্থান’! এ বিষয়ে তিনি একটি বইও লিখেছিলেন, ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জনগণের হাতে ক্ষমতা—নির্বাচন না অভ্যুত্থান’ গ্রন্থ।

সেসময় কমিউনিস্ট নামধারী অনেক দল, কর্মী ও নেতারা উমরের এই তত্ত্ব ও সূত্র নিয়ে হাসাহাসি করেছিলেন এবং উমরকে তাচ্ছিল্যভরে নানা কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু নিকট ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন।

১৯৭২ সাল থেকেই উমর আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রাজনীতি, ক্ষমতাসীন ফরিয়া-ব্যবসায়ী শ্রেণির দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লিখে চলেছিলেন।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে জনগণের ভোটের অধিকার ছিনতাই করে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বিষয়ে, সেই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য গুম খুন মামলা নির্যাতন, উন্নয়নের মেগা প্রজেক্টের নামে কোটি কোটি টাকা চুরি ও বিদেশে পাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং ৭ জুলাই ২০২৪ সালে ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘আওয়ামী লীগকে মেরে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে’!

জুলাই ২০২৪ সালে অত্যন্ত ব্যাপক এবং সর্বগ্রাসী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদেশের জনগণ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসকদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল।

উমরের কণ্ঠ থেকে গেলেও তার লেখা, সমাজ পরিবর্তনের সূত্রাবলী, ইতিহাসের গতিপথ নিয়ে তার দিকনির্দেশনা আমাদের পথ দেখাবে, অনুপ্রাণিত করবে আগামী দিনের লড়াইয়ের মাঠে।

তাই আপনাকে বিদায় বলব না উমর ভাই, বিদায় নয় কমরেড বদরুদ্দীন উমর, আপনি প্রতিক্ষণে, প্রতিপদে আমাদের সাথে আছেন, থাকবেন।

মুহাম্মদ কাইউম : চলচ্চিত্র নির্মাতা; সদস্য বাংলাদেশ লেখক শিবির, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:২৬ ভোর
যোহর ১২:৫৭ দুপুর
আছর ০৪:২৫ বিকেল
মাগরিব ০৬.১৩ সন্ধ্যা
এশা ০৭:২৭ রাত

সোমবার ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫