শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বাংলাদেশে ধনবান হওয়ার জন্য কি তবে রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা চলছে? সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ থেকে কাস্টমস কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দশা দেখে তাই মনে হবে। আছে আরও অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তা। বিপুল আর্থিক কেলেঙ্কারি, সরকারি সম্পদ হস্তগত করার অনাচার ক্রমশ বাংলার আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে তুলেছে।
ধনবান হওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু সেই ধন কীভাবে আসছে সেইটাই বড় প্রশ্ন। যেভাবে বড় মাপের সব কেলেঙ্কারি ফাঁস হচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, দুর্নীতিপরায়ণরা পুরো শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতিকেই সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে।
দুর্নীতি রোধ করার রকমারি রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও নজরদারি পদ্ধতি থাকার পরও দুর্নীতির পক্ষে জুতসই পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বেনজীর আহমেদের পর সাবেক ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার তথ্য আসতে না আসতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমানের দুর্নীতির যে বিবরণ আসছে তা মানুষকে বিস্মিত করেছে।
সাধারণ মানুষের সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পর্কে এতদিন ধারণা ছিল যে, এরা কাজ করার নামে দুর্নীতি করে। তাও এখন ভেঙে গেছে। মানুষ এখন ভাবতে শুরু করেছে, এরা আসলে কাজ করে না, শুধু দুর্নীতিই করে।
বেনজীর আহমেদ, আছাদুজ্জামান মিয়া, মো. মতিউর রহমান—এই তিনজনই নয়। পুলিশ, কাস্টমস আর কর বিভাগ, ভূমি অফিস, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, গ্যাসসহ প্রতিটি সরকারি অফিস এখন একেকটি দুর্নীতির ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিও সাধারণ মানুষের জীবন প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ফেলেছে। সত্যি বলতে কি, দুর্নীতির উপর্যুপরি প্রমাণে দেশবাসী আজ বিধ্বস্ত ও অবসন্ন।
বৃহত্তর সমাজের হতাশার প্রত্যক্ষ কারণ হলো, দুর্নীতিবাজরাই এখন সমাজে সম্মানিত হচ্ছেন। একটা কথা তো বলাই হয়, যে সমাজ যত বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তার দুর্নীতি-প্রবণতা আরও বেশি করে বাড়তে থাকে। এর পেছনে রাজনৈতিক মদদ আছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা আছে, উদাসীনতা আছে এবং অতি অবশ্যই অনেকের যোগসাজশ আছে।
রাজনৈতিক দল ও সরকারের সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের সম্পর্ক অনেকটা সক্রিয় প্রশ্রয়দাতার ওপর নির্ভরতার মতো। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, রাজনীতি দুর্নীতিকে চালায়, না কি দুর্নীতি রাজনীতিকে চালায় এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।
এতদিন আমরা বলতাম দেশে দুর্নীতি বাড়ছে। এখন বলতে হচ্ছে, দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। কেন ছেয়ে গেছে তা সবিস্তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বৃহত্তর পরিসর থেকে ক্ষুদ্র পরিসর, সর্বত্রই যে রূপে দুর্নীতির ছায়া ক্রমপ্রসারণশীল তাতে বিশ্বের বুকে দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নতুন কোনো পরিচয়ই দাঁড়িয়ে যায় কিনা তা ভাববার বিষয়।
জনজীবনের প্রত্যন্ত স্তরে এখন দুর্নীতির গ্রাস। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাস, পানি, জমি খাজনা অর্থাৎ জীবনের নিত্যকার কোনো সেবা পরিষেবা এখন দুর্নীতির বাইরে নেই।
নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে যারা দুর্নীতি করে তারা নাগরিকদেরও সেই রকম একটা চক্রে ফেলে দিয়েছে। নাগরিক সমাজের মানুষ যে যার মতো করে দুর্নীতির সঙ্গে একটি বোঝাপড়া করে নিয়েছেন। কীভাবে বিদ্যুৎ আর অন্যান্য সেবার বিল ফাঁকি দেওয়া যাবে, কী রূপে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা যাবে, সেইসব ব্যাকরণের চর্চা অধিকাংশ মানুষই অল্পাধিক করছেন।
জীবনযাপনের প্রাত্যহিক স্তরে ছোট ছোট দুর্নীতিতে মানুষকে অভ্যস্ত করে বড় দুর্নীতির রাস্তাটা পরিষ্কার করে রেখেছেন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব। বহুমাত্রিক দুর্নীতির গ্রহণযোগ্যতা এভাবেই তৈরি হয়েছে। এইটাই প্রকৃত সংকট। নাগরিক সমাজের দুর্নীতি চলছে এবং চলবেও।
দুর্নীতি কমবে কীভাবে তা জানতে চায় অনেকে। কোনো একটি সহজ উপায়ে সব রকম দুর্নীতি রুখে দেওয়া যাবে, এই প্রত্যাশা অযৌক্তিক। বাংলাদেশে মুক্ত অর্থনীতি এলে লাইসেন্স-পারমিটের ব্যবসা কমবে। সরকারি কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ কমবে, তাই দুর্নীতিও কমবে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন উলটোটাই ঘটেছে।
বাজার খুলে যাওয়ার পর দুর্নীতি যেন আরও বেড়ে গিয়েছে। এমনকি সরকারি কর্মীদের বেতন কয়েকগুণ বাড়ানোর সময়ও আশা করা হয়েছিল ওরা কম দুর্নীতি করবে। বরং দেখা গেল ওদের ঘুষের রেট বেড়েছে বেতনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটছে। এসব যত হচ্ছে ততই দাম বাড়ছে জমির, যেগুলোর মালিক আসলে জনগণ। যারা সেইসব সম্পদ ন্যস্ত করার বিষয়ে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, সেই নেতা-আমলাদের সামনে প্রলোভনও তাই আজ অনেক বেশি।
নিজের দফতরকে ব্যবহার করে আখের গুছিয়ে নেওয়ার দুর্নীতি বেড়ে গেছে এই কারণেই। দারিদ্র দূরীকরণের নানা প্রকল্পে আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা আসছে। উন্নয়ন প্রকল্পে টাকা ঢালা হচ্ছে দেদারসে আর সেইভাবে দুর্নীতির ইন্ধন ও আয়তন, দুই-ই আজ অনেক গুণ বেড়ে উঠেছে।
একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মিত না হওয়ার দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের। রাজনীতিতেই দুর্নীতি অনেক বেড়েছে। কেন্দ্রে তো বটেই, পাড়া মহল্লার কমিটি গঠনও এখন টাকা ছাড়া কঠিন হয়ে পড়ছে। নেতারা টাকা খাচ্ছেন আর দলের ভেতরে বড় আকারে পদ বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য, কমিটি বাণিজ্যের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থার দশাও তথৈবচ।
মামলার পাহাড় জমে যাওয়ায় যেকোনো অভিযোগের সমাধান সহজে হয় না। ফলে বিচার বিভাগের লোকজনেরও দু’পয়সা গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
কী করতে হবে সেইটাও বড় সংশয়ের জায়গা তৈরি করেছে। ঘুষখোরের শাস্তি বাড়ালে একটা আশঙ্কা যে ঘুষের অঙ্কটাই বেড়ে যেতে পারে। তাই শাস্তি ছাড়াও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ঘুষ খাওয়ার সুযোগ কমে যায় এবং যাতে ঘুষ না-খাওয়াকেই ভালো বলে মনে হতে থাকে। কেবল নৈতিক বোধের কারণে নয়, নিজের স্বার্থরক্ষার বা সুবিধার জন্য।
আমাদের প্রশাসনের পদ্ধতি এমনই যে, বহু লোকের কোনো একটি কাজ আটকানোর ক্ষমতা রয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের। টাকা দিয়েও কাজ উদ্ধার হয় না, এমনই বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য আমাদের ব্যবস্থায়। ব্যবস্থার পরিবর্তন না এনে চিৎকার করে দুর্নীতি কমানো যাবে না।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)