শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১


এবার একটু অন্যরকম শোকের মাস!

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

প্রকাশিত:১ আগষ্ট ২০২৪, ১৪:১৬

ছবি সংগৃহিত

ছবি সংগৃহিত

আগস্ট শোকের মাস। বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনাবিধুর মাস। জাতির পিতার বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ডের মাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, পলিটিক্যাল ক্যাটাগরি হিসেবে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জন্মদাতা, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সা‍র্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।

তাই, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ইতিহাসের কলঙ্কতম দিন। অবিভক্ত ভারতবর্ষের (১৯৪৭ পর্যন্ত), বিভক্ত পাকিস্তানের (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত) এবং স্বাধীন বাংলাদেশের (১৯৭১ সালের পরবর্তী) শত বছরের সম্মিলিত রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার মতো কলঙ্কজনক অধ্যায় আর একটিও নেই।

শত বছরের ইতিহাসে যেমন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৫১১-এর বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন, ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৭-এর দেশভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ প্রভৃতি এতদ অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এতদ অঞ্চলের বিগত একশো বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক, জঘন্যতম এবং ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। জাতির জনকের এ হত্যাকাণ্ড ঘটে কোনো বিদেশি শত্রুর হাতে নয়, বরঞ্চ এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার, এদেশেরই আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা কিছু অমানুষ, বাঙালির জাতির পিতাকে হত্যা করে ইতিহাসের এ নৃশংসতম এবং জঘন্যতম কলঙ্কের জন্ম দিয়েছে।

ইতিহাসের এ নৃশংসতাকে মনে রেখে জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার জায়গা থেকে পুরো আগস্ট মাস আমরা জাতীয়ভাবে শোকের মাস হিসেবে পালন করি। এবারও তাই হবে কেননা জাতি হিসেবে পিতার প্রতি জাতির সম্মান প্রদর্শনের এটা একটি প্রতীকী অনুশীলন।

এবারের শোকের মাসে শোক পালনের দীর্ঘশ্বাস এবং স্বাভাবিক নিঃশ্বাস যেন একটু ভারি ভারি লাগছে। কেননা, জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তপাত এবং শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের মনকে, হৃদয়কে এবং বিবেককে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে একবার কোটা সংস্কারের আন্দোলন হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে প্রায় ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় মেধাবীদের সুযোগ সংকোচিত হয়- এ ব্যাখ্যা ও যুক্তি দিয়ে কোটার একটা যৌক্তিক সংস্কারের দাবি উঠেছিল। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি সরকারি পরিপত্র জারির মাধ্যমে ২০১৮ কোটা প্রথা একেবারেই বাতিল করা হয়েছিল।

২০২১ সালে দুইজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে জুনের ৫ তারিখ ২০১৮ সালে জারিকৃত সরকারি পরিপত্র বাতিল করা হয়। ফলে, সরকারি চাকরিতে কোটা আবার ফিরে আসে। এ কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পুনরায় আন্দোলন শুরু করে।

সরকারের পক্ষ থেকেও কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিকে সমর্থন করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। আমি নিজেও কোটা সংস্কারের পক্ষে অবস্থান করি, কিন্তু কোটা প্রথা পুরোপুরি বাতিলের বিপক্ষে। সমাজের বিদ্যমান অসমতা জারি রেখে সুযোগের সাম্যতার বিধান অসম জনগোষ্ঠীর প্রতি অবিচার। তাই, বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা বাতিল নয়; সংস্কার চাই।

কেননা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন জনগোষ্ঠী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারীর অবস্থান এবং প্রত্যন্ত জেলার সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সমাজের সুবিধাভোগী এবং সুবিধা সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে এক কাতারে মাপা যাবে না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না দিলে সেটা হবে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার দর্শনের পরিপন্থী। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ নম্বর ধারায়ও সেটা বলা আছে।

তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধার কোটাও বাদ দেওয়ার পক্ষে আমি নই কারণ মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এদেশ স্বাধীন করতে পেরেছি। আজকে আমরা যে একটি মুক্ত, স্বাধীন ও সা‍র্বভৌম দেশে বাস করছি এবং মুক্ত আলো-বাতাস নিতে পারছি সেটা জাতির সূ‍র্যসন্তান এসব মুক্তিযোদ্ধাদেরই জন্য।

তাই, তাদের জন্য কোটা রাখাটা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাতারে মাপা যাবে না। বরঞ্চ এটাকে দেখতে হবে রাষ্ট্রীয় সম্মান, সামাজিক কৃতজ্ঞতা এবং প্রাজন্মিক শ্রদ্ধার স্মারক ও নিদর্শন হিসেবে। কিন্তু সবমিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটাকে সংস্কার করে একটা যৌক্তিক হারে নামিয়ে আনা উচিত।

অবশেষে সুপ্রিম কো‍র্টের আপিল বিভাগ ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ নৃ-গোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ বিশেষ চাহিদা-সম্পন্ন ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য বরাদ্দ রাখার নির্দেশনা দিয়ে একটা রায় দেয়। এ রায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় কেননা সমাজের সর্বস্তরে এর একটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এমনকি ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ও এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।

সরকারও দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিপত্র জারি করে আপিল বিভাগের রায়কে সক্রিয়ভাবে কার্যকর করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনকারী এবং সরকার উভয়েরই যদি একই চাওয়া হয়, তাহলে কেন এত রক্তপাত হলো? কেন এত মানুষকে হত্যা করা হলো? কেন কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেশে একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হলো?

কেন বাংলাদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে হলো? কেন হাজারেরও বেশি লোককে কারাগারে যেতে হলো? কেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ? কেন পুলিশকে জীবন দিতে হলো? কেন ছয়জন সাংবাদিককে জীবন দিতে হলো?

কেন ৪ বছরের আহাদ, ৬ বছরের রিয়া, ১০ বছরের হোসাইন, ১১ বছরের সামির, ১৩ বছরের মোবারক, ১৪ বছরের তাহমিদ, ১৬ বছরের ইফাত এবং ১৬ বছরের নাঈমাকে জীবন দিতে হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে, এসব নির্মম হত্যাকাণ্ডে যখন জুলাই মাসের পুরোটাই ভারাক্রান্ত তখন আগস্ট মাসে এসে অর্থাৎ জাতীয় শোকের মাসে এসে আমাদের মনটা যেন অন্যান্য বছরের চেয়ে অধিকতর ভারাক্রান্ত, আমাদের নিঃশ্বাস যেন অধিকতর ভারি এবং আমাদের বেদনা যেন অধিকতর বেদনাতুর।

তাই, এবারের শোকের মাস যেন অন্যরকম শোকের মাস। এ শোকের মাসে পিতার সাথে সাথে সন্তান-সন্ততির জন্যও যেন আমরা সামান্য শোক বরাদ্দ রাখি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ।। নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:৫৮ ভোর
যোহর ১১:৪৫ দুপুর
আছর ০৩:৩৬ বিকেল
মাগরিব ০৫:১৫ সন্ধ্যা
এশা ০৬:৩১ রাত

শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪