বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১


জুলাই-আগস্টে নির্বাচনের জন্য কতটা প্রস্তুত বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ১৯:০৮

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে সরকারের পক্ষ থেকে তার দিন-তারিখ নিয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-আগাস্টে নির্বাচন দেওয়ার দাবি করছেন। দলটির পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও প্রশ্ন উঠছে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন হলে বিএনপি সেই নির্বাচনের জন্য কতটা প্রস্তুত। কীভাবেই বা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে দলটি?

বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচনের একটা প্রস্তুতি তাদের নেওয়াই আছে এবং এ প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা মনোনয়ন পেয়েছিলেন তারা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় ইতোমধ্যেই সক্রিয় হয়েছেন ও ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেছেন।

দলটির নেতারা বলছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রার্থীদের পাশাপাশি দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতারা সামনের নির্বাচনে প্রাধান্য পাবেন।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন, মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তাদের সেভাবেই গাইড করা হয়েছে। এটা নির্বাচনি প্রস্তুতিরই অংশ।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান বলছেন, ‘নির্বাচনকে ঘিরে মোটামুটি একটা ছক আমাদের আঁকাই আছে।’ আর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে বিগত সরকারের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। তারা নিজের এলাকায় দলকে সংগঠিত রেখেছেন।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, নির্বাচন কখন হবে সেটি পরিষ্কার না হলেও গত আগস্টের পর থেকেই সারাদেশে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। কারণ সবাই সামাজিক মাধ্যমেও তাদের এসব তৎপরতা তুলে ধরছেন।

প্রসঙ্গত, যে কারণে নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে তা হলো বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি মন্তব্য। গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

বিএনপি শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর আগে ২০১৮ সালে দলটি অংশ নিয়েছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হয়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল দলটি।

কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি?

বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দল থেকে ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী বেশিরভাগ এলাকাতেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলের বিভিন্ন ইউনিট পুনর্গঠনের পাশাপাশি ব্যাপক জনসংযোগ করছেন।

এছাড়া জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কার্যক্রমে বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্থানীয় বিএনপি নেতারাই এখন মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন।

গত আগস্টে সিলেট ও ময়মনসিংহসহ যেসব এলাকায় বন্যা হয়েছে সেসময় ওইসব এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের উপস্থিতি ছিল দৃশ্যমান। এবার শীতের শুরু থেকেই শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানাভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা, যার মূল লক্ষ্য হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, যেকোনো সময় নির্বাচন হলেও তার জন্য বিএনপি প্রস্তুত আছে। ‘আমরা দ্রুত নির্বাচন চেয়েছি এবং সেজন্য প্রস্তুতিও আছে আমাদের। তারিখ ঘোষণা হলেই আমরা আনুষ্ঠানিক মনোনয়নে যাব। কিন্তু এর মধ্যেই এলাকাগুলোতে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনমত গঠনের কাজ করছেন, মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এসব কিছুই তো নির্বাচনি প্রস্তুতির অংশ।-বলেন তিনি।

আরেক প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন জানান, ‘২০১৮ সালের যারা দলের প্রার্থী ছিল তাদের অনেককে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। আমাদের সঙ্গে যারা আন্দোলনে ছিলেন তাদের বিষয়েও কিছু নির্দেশনা গেছে মাঠ পর্যায়ে।’

জানা গেছে, কিছু এলাকা বাদ দিয়ে বাকি সব এলাকাতেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরাই বিএনপিতে এবার প্রাধান্য পাবেন। ওই নির্বাচনের আগের রাতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে ‘ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভর্তি করে রাখার’ ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিল।

‘২০১৮ সালের নির্বাচনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করেছেন বলেই নির্বাচন নিয়ে পতিত সরকারের প্রতারণা দেশ ও বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল। অনেকেই হামলার শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ গুলির মুখে পড়েছিলাম। সে কারণে দল মনে করে আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার পাওয়াটা স্বাভাবিক।’-বলেন মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। সেবার গণফোরামকে সাতটি, নাগরিক ঐক্যকে পাঁচটি, আ স ম রবের জেএসডিকে পাঁচটি, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে দুটি আসন ছেড়ে দিতে হয়েছিল বিএনপিকে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার জন্য অন্তত পঁচিশটি আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি।

দলের নেতারা জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে এবার আর জোটবদ্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার কারণে ধারণা করা হচ্ছে যে জামায়াত ও বিএনপি পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবেই নির্বাচনের মাঠে আসতে যাচ্ছে। তবে কিছু এলাকায় বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে ছিল অন্য দলের এমন কয়েকজন নেতাকে ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত বিএনপি ইতোমধ্যেই দিয়েছে।

গত বছর ২২ অক্টোবর সমমনা শরিক দলগুলোর ছয়জন নেতাকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় সহযোগিতার জন্য ছয়টি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের জরুরি চিঠি দেওয়া হয়েছিল দলটির দফতর থেকে। ওই ছয় নেতা হলেন- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব (লক্ষ্মীপুর-৪), নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না (বগুড়া-৪), গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি (ঢাকা-১২ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬), গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর (পটুয়াখালী-৩) ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান (ঝিনাইদহ-২) এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা (কিশোরগঞ্জ-৫)।

এছাড়া কিছু এলাকায় দলের একাধিক শক্ত প্রার্থী থাকায় সেখানকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের কোনো ধরনের সংঘাতে না জড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব আসনের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন বলে দলের নেতারা ধারণা দিয়েছেন।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলছেন, সারাদেশে দল গোছানোর কার্যক্রম চলছে এবং এর পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্থানীয় সম্ভাব্য প্রার্থীরা সক্রিয় হয়েছেন।

‘নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে আমাদের মোটামুটি একটা ছক আঁকা আছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় হয়তো অল্প কিছু পরিবর্তন হবে। এরপর আসবে মনোনয়নের প্রশ্ন। নেতাকর্মীরা সবাই প্রস্তুত। যারা দীর্ঘদিন কাজ করছে এলাকায় তাদের মধ্যে কারা জনপ্রিয় সেটা নিয়েও দল স্টাডি করছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যেই আমরা আছি।’ বলেন সেলিমা রহমান।

আর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, নির্বাচনের জন্য বিএনপির আলাদা করে প্রস্তুতির প্রয়োজন খুব একটা নেই। বিএনপির দুটি অঙ্গীকার আছে- একটি হলো দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ আর দ্বিতীয়টি হলো বিএনপি দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আন্দোলনের সহযাত্রীদের নিয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার করা। এ দুটি বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ চলছে। তবে আমাদের বড় প্রস্তুতি হলো বিএনপির জন্য মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া সহানুভূতি।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, এখন নির্বাচনী এলাকাগুলোতে যাদের সক্রিয় দেখা যাচ্ছে এদের বেশিরভাগই ২০১৮ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন।

‘শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব নেতারা নিজ নিজ এলাকায় দলীয় কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমনকি প্রশাসন থেকে স্থানীয় বিষয়গুলোতে তাদের সাথেই যোগাযোগ করা হচ্ছে। প্রশাসনের আয়োজনে অনুষ্ঠানগুলোতেও তারা গুরুত্ব পাচ্ছেন। তবে এর বাইরে আরও যারা গত ১৫ বছরে গ্রেফতার, মামলা হামলায় জর্জরিত হয়েছেন কিন্তু গত নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না তারাও কিন্তু সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কতজন দলের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।’ বলেন জোবাইদা নাসরীন।

তবে নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কখন হয় তা এখনো কারও জানা নেই। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াত সংস্কার কাজ আগে শেষ করার ওপর জোর দিচ্ছে। ওদিকে সরকার ঘনিষ্ঠ ছাত্ররা দল গঠনের প্রস্তুতি শুরু করেছে।

সরকারের দিক থেকে প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য চলতি বছরের শেষ বা আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা উল্লেখ করেছেন।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৫:২৩ ভোর
যোহর ১২:০৮ দুপুর
আছর ০৩:৫৭ বিকেল
মাগরিব ০৫:৩৬ সন্ধ্যা
এশা ০৬:৫৩ রাত

বুধবার ১৫ জানুয়ারী ২০২৫