বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
হজরত সালমান ফারসী রা.-এর জন্ম পারস্যে। তার মা-বাবা ছিলেন অগ্নিপূজারী। বাবা ছিলেন গোত্র প্রধান। অগ্নিপূজারী সমাজে বেড়ে উঠার সুবাদে তিনি পূজার দেখভালের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান। বেশির ভাগ সময় সালমান ফারসীকে তার বাবা বাড়িতে আটকে রাখতেন, বাইরে বেরোতে দিতেন না খুব বেশি।
একদিন চাষাবাদের জমির খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য তাকে বাইরে পাঠালেন বাবা। যাওয়ার পথে খৃষ্টানদের একটি গির্জা চোখে পড়লো। তাদের ইবাদত পদ্ধতি খুব পছন্দ হলো তার। সেখানে জানতে পারলেন এই ধর্মের উৎপত্তি শামে।
সেখানে সারাদিন কাটিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। সারাদিনের কাজের খবর শুনতে চাইলে বাবাকে তিনি জানালেন, কাজে যাননি। খৃষ্টানদের গির্জায় কাটিয়েছেন সারাদিন। তাদের ধর্মাচার খুব পছন্দ হয়েছে।
বাবা তাকে বললেন, এই ধর্মের মানুষদের কাছে ঘেঁষা বন্ধ করো। এতে কোনো কল্যাণ নেই। তোমার পূর্বপুরুষের ধর্মই সত্য ও কল্যাণকর। তিনি বাবাকে বললেন, ওই ধর্মই আমাদের থেকে উত্তম।
ছেলে ধর্মান্তর হওয়ার আশঙ্কায় বাবা তাকে লোহার শিকল পড়িয়ে আটকে রাখলেন। তিনি গোপনে গির্জায় খবর পাঠিয়ে বললেন, শামের কোনো কাফেলা পেলে আমাকে খবর দিও। একদিন সুযোগ বুঝে একটি কাফেলার সঙ্গে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে শামে গেলেন।
শামে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে সেখানকার গির্জার প্রধান পুরোহিতের কাছে গেলেন এবং বললেন, আমি খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছি। এখন আপনার খেদমত করে জীবন কাটাতে চাই। পুরোহিত তাকে সুযোগ দিলেন।
কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সালমান ফারসী রা. বুঝতে পারলেন— পুরোহিত একজন অসৎ ব্যক্তি। তিনি গরীব-দুঃখীকে দানের কথা বলে সমাজের লোকদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেন। কিন্তু তা নিজেই আত্মসাৎ করে পুঞ্জিভূত করে রাখেন।
কিছুদিন পর সেই পুরোহিতের মৃত্যু হলে মানুষ তাকে দাফন করতে এলো। সালমান ফারসী রা. তাদের বললেন, এই লোক ধোঁকাবাজ ছিলো। তাদের দান করা সম্পদ নিজের জন্য আত্মসাৎ করে পুঞ্জিভূত করতো সে। প্রমাণ হিসেবে তার রেখে যাওয়া স্বর্ণ-রৌপ্য ভর্তি সাতটি কলস দেখালেন তিনি। লোকেরা তাকে দাফন না করে শূলে চড়িয়ে তার লাশ ঝুলিয়ে রাখলো।
এরপর অন্য একজনকে সেই পুরোহিতের স্থলাভিষিক্ত করা হলো। নতুন পুরোহিত সৎ লোক ছিলেন। দিন-রাত ইবাদত করতেন। দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত ছিলেন। তার সঙ্গে দীর্ঘ দিন কাটালেন সালমান ফারসী রা.। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি সালমান ফারসীকে মওসুলের এক পুরোহিতের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমার জানামতে আমার পরে, ওই ব্যক্তি অপেক্ষা নিষ্ঠাবান আর কেউ নেই। তুমি খোদার বিধান মেনে চলতে চাইলে তার সংস্পর্শে থাকো।
কথামতো সালমান ফারসী সেই লোকের কাছে গেলেন। তিনিও সৎ ছিলেন। কিছুদিন তার সঙ্গে কাটানোর পর তারও মৃত্যু হলো। মৃত্যুর সময় তিনি সালমান ফারসীকে নাসসীবিনের এক পুরোহিতের সংস্পর্শ গ্রহণের পরামর্শ দিলেন।
নাসসীবিনের সেই পুরোহিতকেও নিষ্কলুষ পেলেন সালমান ফারসী রা.। তবে এই পুরোহিতও অল্প দিনের ব্যবধানে মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে আম্মুরিয়াতের এক পুরোহিতের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন তাকে।
আম্মুরিয়াতের এই পুরোহিতও সৎ এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন। কিন্তু তিনিও বেশিদিন বাঁচলেন না। তবে তিনি মৃত্যুর আগে সালমান ফারসীকে বললেন—
আমরা যেই সত্যকে ধারণ করেছি। আমার জানামতে পৃথিবীতে আর কেউ এমন নেই যিনি এই সত্য ধারণ করেছেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে আরবে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটবে। তিনি জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বড় বড় কালো পাথর ও খেজুর গাছ বিশিষ্ট এক ভূমিতে হিজরত করবেন। তাকে চেনার জন্য স্পষ্ট কিছু নির্দশন থাকবে। তিনি উপহার গ্রহণ করবেন এবং খাবেন। কিন্তু সদকার জিনিস খাবেন না। তাঁর দু’কাধের মাঝখানে নবুয়তের মোহর থাকবে। তুমি পারলে সে দেশে যাও।
আম্মানের সেই পুরোহিত মারা যাওয়ার পর এক আরব কাফেলার সঙ্গে আরবের দিকে যাত্রা শুরু করলেন সালমান ফারসী রা.। মদিনা ও শামের মধ্যবর্তী ওয়াদী আল কুরা নামক স্থানে কাফেলার লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে এক ইহুদির কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিলো। কিছুদিন সেখানে দাসত্ব করলেন তিনি। এ সময় ইহুদির এক চাচাতো ভাই তাকে ক্রয় করে মদিনায় নিয়ে গেলেন। সালমান ফারসী রা. আম্মুরিয়ার সেই পুরোহিতের বর্ণিত শহর দেখে চিনে ফেললেন। রাসূল সা. তখনও মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কিছুদিন পর তিনি মদিনায় হিজরত করলেন।
একদিন সালমান ফারসী মনিবের সঙ্গে বাগানে কাজ করছিলেন। এ সময় মনিবের এক ভাতিজা এসে রাগত স্বরে বললেন, আল্লাহ আউস ও খাজরাজ গোত্রকে ধ্বংস করুন। তারা মক্কা থেকে মদিনায় আগত মুহাম্মদ নামের নবী দাবি করা এক ব্যক্তির অনুসরণ করা শুরু করেছে। এ কথা শুনে সালমান ফারসী রা. তার কাছে গিয়ে এ বিষয়ে আরও শুনতে আগ্রহী হলেন। তা দেখে সালমান ফারসীর মনিব তাকে চড় মেরে বললেন, এসবের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক, তুমি তোমার কাজ করো।
সেদিন সন্ধ্যায় সালমান ফারসী রা. নিজের সংগৃহীত কিছু খেজুর নিয়ে রাসূল সা.-এর কাছে গিয়ে বললেন, এই খেজুরগুলো সদকার আপনি এগুলো গ্রহণ করুন। রাসূল সা. তা নিজের সাথীদের দিলেন। কিন্তু নিজে হাত গুটিয়ে নিলেন।
এর কিছুদিন পর আরও কিছু খেজুর সংগ্রহ করে রাসূল সা.-এর কাছে নিয়ে গেলেন তিনি। বললেন, সেদিন খেয়াল করেছি। আপনি সদকা গ্রহণ করেন না। তাই আপনাকে হাদিয়া দিচ্ছি। তখন রাসূল সা. তা গ্রহণ করলেন।
রাসূল সা.-এর নবুয়তের দুইটি প্রমাণ পাওয়ার পর তৃতীয় প্রমাণের অপেক্ষায় রইলেন তিনি। এর মধ্যে একদিন রাসূল সা. মদিনার বাকী আর গারকাদ কবরস্থানে এক সাহাবিকে দাফন করতে গেলেন। এ সুযোগে সালমান ফারসী রা. রাসূল সা.-এর পিঠের নবুয়তের মোহরটি দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু রাসূলের গায়ে থাকা চাদরের কারণে তিনি তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। তবে সালমান ফারসীর বারবার তাকানোর বিষয়টি বুঝতে পেরে রাসূল সা. চাদর সরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নবুয়তের মোহর দেখতে পেয়ে তা চুমু খেয়ে কেঁদে দিলেন সালমান ফারসী রা.।
রাসূল সা. বললেন, কী হয়েছে তোমার? তিনি রাসূল সা.-কে সব খুলে বললেন। তার এই ঘটনা জেনে রাসূল সা. ও সাহাবিরা অবাক ও আনন্দিত হলেন।
সালমান ফারসী রা. দাস থাকায় ইসলামে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ দুই যুদ্ধ বদর ও উহুদে অংশ নিতে পারেননি। তবে তিনি খন্দক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই যুদ্ধে শত্রুদের ঘায়েল করতে তাঁর পরামর্শেই গর্ত খনন করা হয়। রাসূল সা. তাঁকে খুব পছন্দ করতেন এবং তাঁকে নিজের পরিবারের একজন বলে অভিহিত করতেন।
(আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা, ১৬৬)
মির্জ সাইমা
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)