শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
হজ ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ ফরজ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, وَلِلهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الْبَیْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَیْهِ سَبِیْلًا ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ করা ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)
সামর্থ্য বলতে হজের মৌসুমে হজে যাওয়া-আসার খরচ থাকতে হবে এবং একইসঙ্গে সফরের দিনগুলোতে নিজের ও পরিবারের লোকদের স্বাভাবিক খরচের ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলেও তার ওপর হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম: ২/১৫২; আহসানুল ফতোয়া: ৪/৫১৬)
একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রয় করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৫৩)
হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’(বুখারি: ৭২৮৮)
কারো ওপর হজ ফরজ হলে তার দ্রুত হজ আদায় করে নেওয়া উচিত। অযথা দেরি করতে নিষেধ নবীজি (স.)। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা করে নেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ: ১৭৩২)
যেখানে মানুষের জীবন-মরণের এক সেকেন্ডের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে শুধু এক বছর সময়ও অনেক দীর্ঘ। যে বছর হজ ফরজ হয়, ওই বছরই তা আদায় করা উচিত। অযথা বিলম্ব করা গুনাহ। হজ একবার ফরজ হলে তা আর কখনো মাফ হয় না। (আহসানুল ফতোয়া: ৪/৫২৮)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি হজের ইচ্ছা করে সে যেন তা দ্রুত আদায় করে নেয়। কেননা মানুষ কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে, কখনো সম্পদ খরচ হয়ে যায়, কখনো সমস্যার সম্মুখীন হয়’ (ইবনে মাজাহ: ২০৭)। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘ফরজ হজ আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৮৬৭; সুনানে কুবরা বায়হাকি: ৪/৩৪০)
অনেকে সন্তানের বিয়ে দেওয়ার জন্য হজ আদায়ে বিলম্ব করেন। এটি ঠিক নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানের বিয়ে জরুরি ঠিক আছে, তাই বলে সন্তানের বিয়ের জন্য হজে বিলম্ব করা যাবে না। (রহিমিয়া: ৮/২৭৬)
হজ জীবনে একবার ফরজ বলে যারা এত বড় ফরজিয়াত আদায় করতে অযথা বিলম্ব করে, তারা সারা জীবনের গুনাহ মাফের অবিশ্বাস্য সুযোগ থেকে, এমনকি জান্নাত থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন। কেননা হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করেছে, যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ থেকে ফিরবে সেদিনের মতো (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন’। (সহিহ বুখারি: ১৫২১)। অর্থাৎ সে কবিরা-সগিরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সব গুনাহ থেকে ওইরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে, যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। (ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি: ৩/৩৮২)
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, العمرة إلى العمرة كفارة لما بينهما، والحج المبرور ليس له جزاء إلا الجنة এক ওমরা থেকে আরেক ওমরা পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহর ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজে মাবরুরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। (সহিহ বুখারি: ১৭৭৩; সহিহ মুসলিম: ১৩৪৯; মুসনাদে আহমদ: ৭৩৫৪; সহিহ ইবনে হিববান: ৩৬৯৫)
উপরন্তু সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করার পরিণাম ভয়াবহ। ফরজ হজ ত্যাগ করলে ইহুদি-নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, من أطاق الحج فلم يحج فسواء عليه مات يهوديا أو نصرانيا
যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খ্রিস্টান হয়ে, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই। (ইবনে কাসির: ১/৫৭৮)
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ হজ না করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, অতঃপর (গড়িমসি করে) তার পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায় অথচ আমার দিকে (হজব্রত পালন করতে) আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।’ (ইবনে হিব্বান: ৩৭০৩)
উল্লেখ্য, নারীদের হজ ফরজ হওয়ার জন্য সামর্থ্যবান হওয়ার পাশাপাশি সফরে স্বামী বা মাহরাম পুরুষ থাকাও শর্ত। (ফতোয়ায়ে শামি: ২/৪৫৫) মাহরাম না থাকলে সামর্থ্য থাকার পরও নারীদের ওপর হজ ফরজ হবে না। আবার মাহরামের খরচ বহনের সামর্থ্য না থাকলেও নারীদের ওপর হজ ফরজ নয়। তবে, মাহরাম যদি ফরজ হজ করতে যায়, সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে গেলে খরচ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। (বাহরুর রায়েক: ২/৩৩৯)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের হজের গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি দান করুন। সবাইকে সঠিকভাবে হজ আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)