রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২
ছবি- দৈনিক সময়
রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরিক্ষা ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এডহক কমিটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও বোর্ডের বিধান উপেক্ষা করে পত্রিকায় একাধিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাশাপাশি তড়িঘড়ি করে নিয়োগ পরিক্ষা নিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক।
জানা গেছে, বর্তমানে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় পরিচালনা করছে এডহক কমিটি। চলতি মাসের ১৪ তারিখে প্রফেসর ড. মোঃ রাসেল মাহমুদ হাসান প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। তার আগে সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোসামৎ মাকসুদা বেগম খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের এই প্রক্রিয়া শুরু করেন- যা বর্তমান অধ্যক্ষ রাসেল মাহমুদকে দিয়ে বাস্তবায়নের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে এডহক কমিটি।
সূত্র জানায়, শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোসামৎ মাকসুদা বেগম গত ২৫ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। ওই বিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিক শাখায় বাংলা ও ইংরেজির জন্য ০১ জন করে মোট ০২ জন এবং মাধ্যমিক শাখায় গনিত, ইংরেজি ও বাংলার জন্য ০২ জন করে মোট ০৬ জন। হিন্দুধর্ম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, রসায়ন, শরীর চর্চা এবং ইংরেজি ভাষার জন্য ০১ জন করে মোট ০৬ জন খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এরপর ২৭ জুন একই পত্রিকায় ২য় বারের মতো আরেকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তিনি। যেখানে প্রাথমিক শাখায় বাংলা ও গনিতের জন্য ০৬ জন করে মোট ১২ জন, ইরেজির জন্য ০৫ জন এবং হিন্দু ধর্মের জন্য ০১ জন খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়। এছাড়াও মাধ্যমিক শাখায় বাংলার জন্য ০৪ জন, ইংরেজি ০৩ জন, গনিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য ০২ জন করে মোট ১২ জন ছাড়াও ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, সামাজিক বিজ্ঞান, ভূগোল, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, শরীর চর্চা ও ইংরেজি ভাষার জন্য ০১ জন করে মোট ০৭ জন খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যা বোর্ডের প্রবিধান অনুযায়ী সম্পূর্ন অবৈধ।
সূত্র মতে, শিক্ষা বোর্ডের প্রণীত প্রবিধান অনুযায়ী কোনো এডহক কমিটি অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সহকারী শিক্ষক, গ্রন্থাগারিক, সুপারিনটেনডেন্ট বা অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারবে না। শুধু বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)-এর সুপারিশপ্রাপ্ত তালিকাভুক্ত প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এসব বিধি-বিধান উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাকসুদা বেগম ২৫ মার্চ ও ২৭ জুন পত্রিকায় পরপর দু’টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন এবং শুক্রবার (২৫ জুলাই) বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে নিয়োগ পরিক্ষারও আয়োজন করেন।
জানা গেছে, শুক্রবারের নিয়োগ পরিক্ষায় সবমিলিয়ে ৭’শর অধিক পরিক্ষার্থী অংশ নেন যাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩’শ টাকার পে-অর্ডার নিয়েছে এডহক কমিটি। সবমিলিয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ ও পরিক্ষাকে কেন্দ্র করে ২ লাখের বেশি বৈধ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কমিটি। অথচ বিধি অনুযায়ী এডহক কমিটির নিয়োগের কোন ক্ষমতা নাই।
বিদ্যালয়ের একাধিক অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, স্কুলে কোনো শিক্ষক সংকট নাই। বরং গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, ফলাফলেও অবনতি হয়েছে। সে অনুযায়ী শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ‘পর্যাপ্ত’ বলছেন তারা।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটির একজন সিনিয়র শিক্ষক দৈনিক সময়কে বলেন, “বর্তমানে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শাখা মিলিয়ে প্রায় ২৮০০ শিক্ষার্থী রয়েছে এবং এমপিও, স্থায়ী এবং খন্ডকালীনসহ মোট ৬৮ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা কর্মরত থাকা সত্ত্বেও এত বড় নিয়োগের আয়োজন শুধুমাত্র বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। শায়নিকা আক্তার, মাজেদা খানমের মতো (অত্র প্রতিষ্ঠানে ১৭ বছর যাবত শিক্ষকতা করছেন) একাধিক শিক্ষককে বের করে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন অনভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াকে বাণিজ্যের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে দাবি ওই শিক্ষকের।”
খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেরে বাংলা মহাবিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক দৈনিক সময়কে বলেন, “২য় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাকসুদা বেগম হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে ম্যাসেজ দিয়ে মোট ২৫ জন শিক্ষককে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং তাদেরকে নতুন করে আবেদন করার জন্য মৌখিকভাবে বল প্রয়োগ করেন। এদের মধ্যে ১৪ জন শিক্ষক শুক্রবারের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ১০ জন অংশ নেন নাই। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ০৮ জন স্থায়ী শিক্ষককে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা (প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্রাজুইটি, অবসর ও কল্যাণভাতা) বাদ দিয়ে থোক বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর যারা শুক্রবারের পরিক্ষায় অংশ নেয় নাই তাদেরকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেবার চক্রান্ত চলছে।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬৮ জন শিক্ষক আছেন। কোন শিক্ষক সংকট না থাকা স্বত্বেও মাকসুদা বেগম এবং এডহক কমিটির সংঘবদ্ধ একটি চক্র আইন বহির্ভুতভাবে শুক্রবার (২৫ জুলাই) খন্ডকালনি শিক্ষক নিয়োগের পরিক্ষা নিয়েছেন। ওই নিয়োগের বিরোধিতা করে অভিভাবক প্রতিনিধি সম্প্রতি নিম্ন আদালতে মামলা করলে গভর্নিং বডিকে শোকজ করে ৭ দিনের নোটিশ দেন আদালত। আগামীকাল রোববার এ বিষয়ে শুনানীর কথা রয়েছে। কিন্তু তা স্বত্বেও তড়িঘড়ি করে শুক্রবার নিয়োগ পরিক্ষা নিয়েছে চক্রটি।
ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষক দৈনিক সময়কে বলেন, “বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তৎকালীন গভর্নিং বডির সভাপতি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারনেই প্রতিবাদী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এই চক্রের মূল হোতা রিয়াজের সময়ে পদন্নোতিপ্রাপ্ত আরেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমেদ ভূইয়া। যার বিরুদ্ধে ওই সময় প্রতিবাদকারী শিক্ষকরা দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিলেন।” ভুক্তভোগী শিক্ষকদের দাবি- শেরে বাংলা মহাবিদ্যালয়টি যেন কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডকে এই বে-আইনী নিয়োগসহ বিগত কয়েক বছরে সংগঠিত প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ সকল অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মোঃ রাসেল মাহমুদ হাসানের মুঠোফোনে দুই দফা কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন রিপ্লাই দেননি।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)