বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান এই বিক্ষোভ সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকর্তারা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন।
বিক্ষোভ থামাতে সোমবার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে, ইহুদিবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যায় ক্যাম্পাসে সশরীরে ক্লাস নেওয়া আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেসহ অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে, বিক্ষোভ বন্ধ করে ক্যাম্পাসকে শান্ত রাখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের উপর দিন দিন চাপ বাড়ছে বলে জানা গেছে। গত বছরের সাতই অক্টোবর হামাসের হামলার জের ধরে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর থেকেই যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিক্ষোভ এবং তর্ক-বিতর্কের চর্চা বাড়তে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
উভয়পক্ষের শিক্ষার্থীরাই দাবি করেছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিদ্বেষ এবং ইসলামভীতি দু’টোই বেড়েছে। বিক্ষোভ সামাল দিতে গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক সিটি পুলিশকে ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি দেয় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে গিয়ে বিক্ষোভকারী কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ গ্রেফতার করে, যা সারা বিশ্বেই বেশ আলোচিত হয়।
অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারের ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সোমবার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারী প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকশ শিক্ষার্থী গত কয়েক দিন ধরেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চালিয়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, ক্যাম্পাসকে শান্ত রাখার জন্য বিক্ষোভকারীদের “একাধিকবার অনুরোধ” জানালেও তারা সেটি উপেক্ষা করে। সেকারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা পুলিশে খবর দিয়েছেন। অন্যদিকে, বিক্ষোভকারীদের অনেকেই সামরিক অস্ত্র তৈরি খাতে বিনিয়োগ কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও যেসব বিশ্ববিদ্যোলয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং এমারসন কলেজ। কলম্বিয়ার প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছে।
অন্যান্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরাও ইসরায়েলি অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য এসব বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ইহুদি-বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগও রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিও পোস্টে কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের প্রতি সমর্থন জানাতেও দেখা গেছে। যদিও ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিক্ষোভকারীরা। তারা বলছেন যে, তাদের প্রতিবাদ ও সমালোচনা কেবল ইসরায়েল রাষ্ট্রের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে।
এদিকে, সোমবার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, আপাতত তাদের সব ক্লাস অনলাইনে চলবে। “ভীতিকর ও হয়রানিমূলক আচরণ” এড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মিনোচে শফিক।
যেসব শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকেন না, তাদেরকে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সাথে সম্পৃক্ত একজন ইহুদি ধর্মযাজকও কলম্বিয়ার তিনশ ইহুদি শিক্ষার্থীর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন, যাতে পরিস্থিতির “উন্নতি” না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাস না আসার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এছাড়া প্রকাশিত বিবৃতিতে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. শফিক বলেছেন যে, ক্যাম্পাসকে অশান্ত করার জন্যই “কলাম্বিয়ার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন একদল ব্যক্তি বিক্ষোভ ছড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছেন।” “এই সংকট সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করেছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ড. শফিক গত সপ্তাহে ক্যাপিটল হিলে গিয়েছিলেন। সেখানে মার্কিন সরকারের একটি কমিটির সামনে তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি-বিদ্বেষ মোকাবেলার পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের জন্য তাদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নিউইয়র্কের রিপাবলিকান প্রতিনিধি এলিস স্টেফানিকের নেতৃত্বে ফেডারেল আইনপ্রণেতাদের একটি দল সোমবার একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে ড. শফিককে পদত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই চিঠিতে স্টেফানিক বলেছেন যে, “ইহুদি-বিদ্বেষ ছড়ানোর বিক্ষোভ আন্দোলন থামাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে।”
অন্যদিকে, বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি জ্যারেড মস্কোভিটস, জোশ গোটেইমার, ড্যান গোল্ডম্যান এবং ক্যাথি ম্যানিং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। জোশ গোটেইমার বলেছেন যে, চলমান বিক্ষোভের ফলে কলম্বিয়ায় যদি ইহুদি শিক্ষার্থী নিরাপদ বোধ না করেন, সেটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে “মূল্য দিতে হবে”।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা একটি চিঠিতে উত্তর ক্যারোলিনার রিপাবলিকান প্রতিনিধি ভার্জিনিয়া ফক্স লিখেছেন যে, “শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধারে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে”। ভার্জিনিয়া ফক্স বর্তমানে হাউস এডুকেশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
এদিকে, দাতাদের অনেকেই সতর্ক করেছেন যে, দ্রুত বিক্ষোভ থামানো না হলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেবেন। যারা এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এজন প্রাক্তন ছাত্র রবার্ট ক্রাফট তাদেরই একজন। তিনি নিউ ইংল্যান্ড প্যাট্রিয়ট এনএফএল দলের মালিক।
ক্রাফট বলেছেন যে, “সংশোধনমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত” তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিবেন।
অন্যদিকে, বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। তারা মনে করেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিক্ষোভ না থামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা ঠিক হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সোমবার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে। তিনি “ইহুদি-বিদ্বেষমূলক প্রতিবাদের” নিন্দা জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভের পাশাপাশি গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক জায়গাতেই ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীরা সম্প্রতি শিকাগোতে বিক্ষোভ করেছেন। এছাড়া সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ এবং নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজসহ আরও অনেক স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)