বৃহঃস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। দ্য ইদি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস জানিয়েছে, সাধারণত করাচিতে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জনের মৃতদেহ মর্গে নিয়ে থাকে তারা। কিন্তু গত ছয় দিনে তারা ৫৬৮টি মৃতদেহ সংগ্রহ করেছে এবং এর মধ্যে শুধু মঙ্গলবারই ছিল ১৪১টি। তবে প্রতিটি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আলাদা করে এখনই পরিষ্কার কিছু বলা যাচ্ছে না।
করাচির তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি পেরিয়ে যায়, তখন অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে সেটি ৪৯ ডিগ্রির মতো অনুভূত হয়। আর সে সময়ই মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে বলে সেখানকার বিভিন্ন খবর থেকে জানা যাচ্ছে।
করাচি সিভিল হাসপাতাল জানিয়েছে, রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ২৬৭ জন মানুষ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ইমরান সারওয়ার শেখ জানিয়েছেন, এর মধ্যে ১২ জন মারা গেছেন। ‘আমরা দেখছি হাসপাতালে যারা আসছেন, তাদের বেশিরভাগই ৬০-৭০ বছর বয়সী। যদিও কয়েকজন ছিলেন ৪৫ বছর, আর দুজনের বয়স ছিল বিশের কোঠায়,’ বিবিসিকে জানিয়েছেন ডা. শেখ।
যারা হাসপাতালে আসছেন সাধারণত তাদের যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা হলো বমি, ডায়রিয়া ও তীব্র জ্বর।
‘তাদের অনেকেই বাইরে কাজ করতেন। আমরা তাদের বলেছি, তারা যেন প্রচুর পানি পান করেন এবং হালকা জামা কাপড় পরিধান করেন।’
একজন আবহাওয়াবিদ এই উচ্চ তাপমাত্রাকে ‘আংশিক দাবদাহ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা সাপ্তাহিক ছুটির দিন থেকে শুরু হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে কিছুটা পরিত্রাণ দিতে ‘হিটওয়েভ সেন্টার ও ক্যাম্প’ খোলা হয়েছে নানা জায়গায়। বিভিন্ন সড়কে শরীর ঠাণ্ডা করতে শিশুরা পানির ফোয়ারার মধ্যে নেমে পড়ছে।
‘আমার দিকে তাকান। আমার জামা কাপড় ঘামে ভিজে গেছে,’ মোহাম্মদ ইমরান যখন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এটা বলছিলেন তখনও তিনি একটু শীতল হওয়ার জন্য রীতিমত সংগ্রাম করছিলেন। আবার এমন না যে যাদের প্রয়োজন হচ্ছে সবাই হাসপাতালে যেতে পারছে।
ওয়াসিম আহমেদ নামে এক ব্যক্তি যখন কর্মস্থল থেকে বাসায় পৌঁছালেন, তখন তিনি ভালো বোধ করছিলেন না।
পেশায় নিরাপত্তা কর্মী ৫৬ বছর বয়সী এই ব্যক্তি রাতে ১২ ঘণ্টার ডিউটি শেষে মাত্রই ফিরছিলেন তিনি। তখনকার তাপমাত্রাও তার কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে।
ওয়াসিমের কাজিন আদনান জাফর বলছিলেন, ‘তিনি দরজার কাছে এসে বললেন এই গরমে আর পারছি না। তিনি এক গ্লাস পানি চাইলেন। দেয়া মাত্রই তিনি খেলেন এবং মাটিতে পড়ে গেলেন।’
এরপরই ওয়াসিমের পরিবার তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু চিকিৎসকরা জানান যে, হার্ট অ্যাটাকে ইতোমধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছে।
আগে থেকেই তার হার্টের সমস্যা ছিল, কিন্তু এ ধরনের দাবদাহে তিনি আগে প্রত্যক্ষ করেননি।
উচ্চ তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নিতে এই মুহূর্তে বেশ সংগ্রাম করছে করাচি শহর। এর মধ্যে প্রতিদিনকার লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়েও অনেকেই ভীত। কারণ অনেকেই একটু শীতল বাতাসের জন্য ফ্যান বা এসি চালান।
লোডশেডিং এ যারা ভোগান্তিতে পড়েছেন তাদের একজন মুহাম্মদ আমিন। কোথাও বিদ্যুৎ চলে গেলে পাকিস্তানজুড়ে একটা সাধারণ প্রাকটিস হলো- সরবরাহ সংরক্ষণের চেষ্টা করে ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড।
মুহাম্মদ আমিনের আত্মীয়রা বলছেন, তাদের ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ না থাকা নিয়মিত ঘটনা। পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মুহাম্মদ এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মারা যান। তার মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। কিন্তু তার পরিবারের ধারণা তীব্র গরমই এর কারণ।
পাকিস্তানের ডন পত্রিকার খবর অনুযায়ী, শহরের রাস্তাঘাট থেকে অন্তত ৩০টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ কর্মকর্তা সুমাইয়া বলছিলেন, ধারণা করা হচ্ছে, এদের অনেকেই নেশা করেন। তবে তাদের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
আর পাকিস্তানে কেবল করাচিই নয়, যারা এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে।
গত মাসেই সিন্ধ প্রদেশে সর্বোচ্চ ৫২ দশমিক দুই ডিগ্রি তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে। সিন্ধ এর রাজধানীই হলো করাচি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও তাপমাত্রা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। ভারত সীমান্তজুড়ে, রাজধানী দিল্লি ‘নজিরবিহীন’ তাপমাত্রা দেখেছে সম্প্রতি। সেখানে প্রতিদিনই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে ছিল গত মে মাস থেকে। কখনো কখনো এটা গেছে ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত। এছাড়া বাংলাদেশেও টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রা বা হিটওয়েভ চলেছে। চিকিৎসকরা বলেছেন এমন পরিস্থিতি তারা আর দেখেননি।
করাচির অধিবাসী মোহাম্মদ জেশান বলছেন সমস্যাটা তাদের কাছে পরিষ্কার। ‘এটা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হচ্ছে,’ তিনি বলছিলেন রয়টার্সকে।
‘সারা বিশ্বজুড়েই এটা হচ্ছে। ইউরোপজুড়েও হচ্ছে। তারা তীব্র তাপের মুখে কিন্তু তারা সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরাও অনেকে বলে থাকেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই আবহাওয়া মাঝে মধ্যে এমন রুক্ষ হয়ে উঠছে। ধারণা করা হচ্ছে, দাবদাহ আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত বয়ে যাবে করাচির ওপর দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে কমার পূর্বাভাস আছে আবহাওয়া বিভাগের।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা তাকিয়ে আছেন মৌসুমি বায়ুর দিকে, যা দ্রুতই আসবে এবং এ বছর ৬০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি বয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। একজন বিশেষজ্ঞ ডন পত্রিকাকে এমনটাই বলেছেন।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)