শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
মুঘল শাসন ভারতবর্ষকে মহীয়ান করেছিল। তাদের শাসনামলে ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছিল বিশ্বের ধনী, সমৃদ্ধ, সুশিক্ষিত, শিল্পময়, সাংস্কৃতিবান জনপদ। গজল, কাসিদা, দৃষ্টিনন্দন চিত্রকলা আর বাহারি স্থাপত্যশৈলী যেমন মুঘলদের নিজস্ব অবদান, তেমনি রসনালোলুপ সুস্বাদু মুঘলাই খাবার আর পশমি-জরিদার পোশাক-পরিচ্ছদও মুঘলদের একান্ত কীর্তি। সবকিছু মিলিয়েই সামগ্রিকভাবে মুঘল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরম্পরা ও ঐতিহ্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলো দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষে সুসংবদ্ধ, উদার, বহুত্ববাদী সুশাসনের প্রবর্তন।
মুঘলদের জীবনযাত্রা ছিল বেশ আমুদে। নানা ডিজাইন খচিত পোশাক-আশাকে মন ভরে মাখতেন বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি। বলা বাহুল্য, মুগলদের পছন্দের তালিকায় ছিল সুগন্ধি আর বাহারি আতর। ষোড়শ’ শতকের পর সুগন্ধি ও আতর তৈরির জন্য ঢাকার এক এলাকায় প্রচুর ফুলের চাষ করা হয়। ফুল উত্পাদনের কারণেই অত্র এলাকার নামকরণ হয় ‘ফুলবাড়িয়া’।
পরবর্তীকালে এই এলাকাতেই ঢাকার প্রথম রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়। কমলাপুর রেলস্টেশনের আগে এটাই ছিল পূর্ববাংলার কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন। একটি একতলা ভবন ও প্ল্যাটফর্ম নিয়েই তৈরি করা হয়েছিল সেটি, তবে সাথে ছিল একটি রেল ইয়ার্ডও। মূলত রেল সংযোগের একটি বড় কারণ ছিল ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাট উৎপাদন ক্ষেত্র ও নারায়ণগঞ্জের নদীবন্দরের মধ্যে একটি দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের ব্যবস্থা করা।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে পরিবহন সুবিধার জন্য ব্রিটিশ সরকার এখানে ৫০ একরেরও বেশি জমিতে রেললাইন স্থাপন শুরু করেছিল। সেবছরই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ রেল লাইন স্থাপন করা হয়। তখন এর নাম ছিল ‘ঢাকা স্টেট রেলওয়ে।’
চল্লিশের দশকের ঢাকা স্মৃতিগ্রন্থে সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, ‘ঢাকার রেলস্টেশন বলতেই ফুলবাড়িয়াকে বোঝানো হতো।’ পুরান ঢাকার নানা স্মৃতি নিয়ে মীজানুর রহমানের লেখা ঢাকা পুরাণ স্মৃতিগ্রন্থে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের বিশদ বর্ণনা আছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘স্টেশনের নাম ছিল ফুলবাড়িয়া, কিন্তু প্ল্যাটফর্মের দুই মাথায় নামফলকে খোদাই করা ছিল ঢাকা। মফস্বলের স্টেশন যেমন হয় ফুলবাড়িয়া ছিল তেমনি সাদামাটা।’
১৯৫০ সালের মাঝ পর্ব পর্যন্ত ঢাকার রেলস্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। সেই সময় ফুলবাড়িয়া স্টেশন ঘিরে রাখত সাধারণ মানুষ, মুটে-মুজুর, কুলি-কামলারা। গল্প-আড্ডা বসাতেন শিল্পী- সাহিত্যিকরা। বই এবং পত্রপত্রিকার স্টল তাদের আকৃষ্ট করত ভীষণভাবে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে থার্ড ক্লাস ক্যানটিনের বেঞ্চিতে বসে কবিরা আড্ডা দিতেন বলে জানা যায়। আড্ডা যারা জমিয়ে তুলতেন তাদের মধ্য থেকে কবি শহীদ কাদরী ও মাহমুদুল হকের নাম পাওয়া যায়।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ঢাকায়ও এর বিভিন্ন প্রভাব পড়তে শুরু করে। পূর্ববঙ্গের রাজধানী হয় ঢাকা। শহরে মানুষের চাপও বাড়তে থাকে। তখন ট্রেন তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন থেকে সরাসরি ফুলবাড়িয়ায় যেত। ক্রমে এই এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সে কারণেই এই রেলস্টেশন সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করা হয়। কমলাপুর রেলস্টেশন নির্মাণ ও রেললাইন স্থাপনের কাজ ১৯৫০-এর শেষ দিকে শুরু হলেও তা চলতে থাকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৮ সালের ১ মে, কমলাপুর রেলস্টেশন চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত রেলস্টেশন বলতে সবাই ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনকেই চিনত।
২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের ফুলবাড়িয়া পুরাতন স্টেশনে ঈদ উপলক্ষে সিলেট রুটের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। এবার ঈদেও হয়তো এখান থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রি হবে। ঢাকার বঙ্গবাজারের কাছে রেলপথ পরিদর্শন অধিদপ্তরের পুরোনো ভবনের পাশেই নতুন একটি টিনশেডে কাউন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেটাই এখনকার ‘ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন’।
পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব রফিকুল ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘একসময় এখানেই ছিল ঢাকার মূল স্টেশন। এই ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকেই আমরা ট্রেনে উঠতাম। এখন তো এসব স্মৃতি। এখনকার পোলাপান তো এই স্টেশন চেনেই না।’
আগে যেখানে ‘ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন’ ছিল, এখন সেখানে বিআরটিসিসহ বেশকিছু বাসের কাউন্টার রয়েছে। যেসব জেলার মানুষ বাসে পদ্মা পার হন, তারাই এখন ভিড় জমান স্মৃতিঘেরা জায়গাটিতে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)